লেখা: সে-ওয়াং কু।
আগস্টের ৩০ তারিখ ছিল বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে আমেরিকানদের প্রত্যাহারের আগের দিন। সেদিনে হোয়াটসঅ্যাপে আমি পারওয়ানাকে (ছদ্মনাম) একটি বার্তা পাঠাই। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘কীভাবে তঁার দিন কাটছে।’ উত্তরে চাকরি ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বললেন, ‘এখন কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না…কিন্তু আমরা ভালোই আছি। ঠিকঠাকভাবে হিজাব পরে আমি অন্তত বাইরে বের হতে পারছি।’
পশ্চিমাদের প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার শেষ দিনগুলোতে পারওয়ানা উড়োজাহাজে করে কাবুল ছাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাগজপত্রে ত্রুটির কারণে তিনি যেতে পারেননি। পারওয়ানার মতো একই পরিস্থিতিতে পড়া তরুণ, শিক্ষিত এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সংখ্যা কম নয়। আমি তঁার মতো শত শত আফগান নারীর চিঠি পেয়েছি। তঁারা সবাই তঁাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো ভয়ে আছেন। তালেবাননিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার জন্য তঁারা মরিয়া।
আগস্টের ১৫ তারিখে তালেবানের কাবুল প্রবেশের পর থেকে একটা স্বেচ্ছাসেবামূলক উদ্যোগে আমি নেতৃত্ব দিচ্ছি। আমরা ২০০-এর বেশি আফগান তরুণী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা দিচ্ছি। স্বেচ্ছাসেবার এ ধারণা আমার ভেতরে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশের এশিয়া ইউনিভার্সিটি অব উইমেনের প্রাক্তন ও বর্তমান ১৮০ আফগান শিক্ষার্থীর কাছ থেকে। তঁারা আফগানিস্তান থেকে অন্য দেশে পালিয়ে যেতে চাইছিলেন। আমি তাঁদের অন্য দেশে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এ ঘটনার পর আফগানিস্তান ছাড়তে চাওয়া অন্য নারীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ স্থাপন হয়।
আফগানিস্তান থেকে প্রকৃতপক্ষে যঁাদের উদ্ধার করা দরকার, এমন অসংখ্য নারীকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিমারা। কিন্তু হতভাগ্য এসব নারী পশ্চিমা সরকার ও সংস্থাগুলোর কাছে অগুনতি ই-মেইল পাঠাচ্ছেন, হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠাচ্ছেন। তঁাদের সহযোগিতার ব্যাপারে পশ্চিমারা কতটা উৎসাহী, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
পশ্চিমা সরকারগুলো কাবুল থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আফগান নাগরিক ও বিদেশিদের নিয়ে গেছে। এ সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজারের বেশি। কিন্তু এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষ আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য ব্যক্তিগতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে প্রকৃতপক্ষে যঁাদের উদ্ধার করা দরকার, এমন অসংখ্য নারীকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিমারা। কিন্তু হতভাগ্য এসব নারী পশ্চিমা সরকার ও সংস্থাগুলোর কাছে অগুনতি ই-মেইল পাঠাচ্ছেন, হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠাচ্ছেন। তঁাদের সহযোগিতার ব্যাপারে পশ্চিমারা কতটা উৎসাহী, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, পশ্চিমাদের তরফে কোনো সাড়া মিলছে না। পশ্চিমারা যাঁদের বেমালুম ভুলে গেল, তাঁদের মধ্যে এখন হতাশা গেড়ে বসেছে।
ফারজানার মতো অনেক আফগান নারী এখন নরকযন্ত্রণা ভোগ করছেন। তিনি ডব্লিউএইচএইচ নামে একটা জার্মান এনজিওতে চাকরি করতেন। বোনের মাধ্যমে তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন ফারজানা। মধ্য আগস্টে তিনি ডব্লিউএইচএইচের কাছে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন জানান। কিন্তু দুই সপ্তাহেও কোনো সাড়া তিনি পাননি।
সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে ফারজানার পক্ষ থেকে আমি ডব্লিউএইচএইচে মানবসম্পদ বিভাগে জরুরি একটি ই-মেইল করি। এক সপ্তাহ পর আমি তাদের উত্তর পাই। তারা আমাকে এমন কোনো নথি পাঠাতে বলে, যেটা থেকে প্রমাণ করা যায় ফারজানা তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ব্যাপারটা এমন যেন তাদের প্রতিষ্ঠানে কারা কাজ করতেন, সে সম্পর্কে ডব্লিউএইচএইচের কাছে কোনো নথিই নেই।
ই-মেইলে আমার অনুরোধ পেয়ে এনজিওটি ফারজানাকে বিশেষ ভিসা দেওয়ার জন্য জার্মান সরকারের কাছে অনুরোধ জানায়। কিন্তু তিনি কীভাবে কাছের জার্মান দূতাবাসে যাবেন, সে সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা তারা দেয়নি। আগস্টের ৩০ তারিখ জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস জোর গলায় ঘোষণা দেন, জার্মানির সঙ্গে সম্পর্কিত আফগানদের উজবেকিস্তান প্রবেশ করতে দিতে বাধ্য। কিন্তু ফারজানা কাতারে জার্মান দূতাবাসে যোগাযোগ করলে তাঁকে বলা হয়, বার্লিন এখন কেবল আফগানিস্তানের প্রতিবেশীদের ভিসা দিচ্ছে। ফারজানা এখন কাবুলেই অবস্থান করছেন। এরপর কী করবেন, বুঝতে পারছেন না।
পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত অনেক আফগানের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের ধীরগতির আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না। তালেবান তঁাদের সরাসরি মেরে ফেলবে ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু তাঁদের মধ্যে যে উদ্বেগ ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে, তাতেই তঁাদের মৃত্যু হবে। নিষ্ঠুর বাস্তবতা মেনে নিতে না পারার যন্ত্রণা সঙ্গী করে তঁাদের দিনগুলো এখন কাটছে।
এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। সীমান্ত পেরিয়ে যেসব আফগান পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁরা আমাকে জানিয়েছেন, কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই কোয়েটাতে অবস্থিত জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় একটা সূত্র জানিয়েছে, জাতিসংঘ পাকিস্তানের রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছে। অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে, এমন বিবেচনা থেকে এখন সেসব আফগানকে ফেরত পাঠাচ্ছে পাকিস্তান।
আমি এখানে বলছি না, যারাই আফগানিস্তান ছাড়তে চায় তাদের সবাইকেই পশ্চিমাদের নিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু যঁারা তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, তঁাদের জরুরি সহযোগিতা করতে হবে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
সে-ওয়াং কু কোরিয়া এক্সপোজ পত্রিকার প্রকাশক
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ অক্টোবর ১২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,