লেখক:কাজী আলিম-উজ-জামান।
ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা যে ভাষায় রাশিয়াকে আক্রমণ করেছেন, তা নজিরবিহীন। কোনো ধরনের কূটনৈতিক পরিভাষার তোয়াক্কা না করে সরাসরি তিনি বলেছেন, ‘রুশ অভিযান চূড়ান্তভাবে অযৌক্তিক ও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।’ এরপর তিনি তাঁর জি-৭ সহযোগীদের (জাপান, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র) সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ধারণাতীত অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছেন। জাপানে থাকা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব সম্পদ জব্দ করেছেন, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ তাঁর ঘনিষ্ঠদের ওপর আরোপ করেছেন অবরোধ। এরপর ইউক্রেনের কিয়েভ শহরতলির বুচা শহরে গণহত্যার অভিযোগ এনে গত এপ্রিলে নয়জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছেন।
এত কিছুর পরে রাশিয়া বসে থাকে কী করে! অর্থনৈতিক অবরোধ ও অবন্ধুসুলভ আচরণের প্রতিবাদে জাপানের সঙ্গে সব ধরনের শান্তি আলোচনা বাতিল করেছেন পুতিন। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে জাপানের কয়েকজন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছেন তিনিও, টোকিও যা একেবারেই মেনে নিতে পারেনি।
জাপান ও রাশিয়ার সম্পর্কে শীতলতা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জাপান ছিল হিটলারের জার্মানি ও মুসোলিনির ইতালির সঙ্গে এক জোটে। অক্ষশক্তি নামে পরিচিত ছিল তারা। অপর দিকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন নিয়ে গঠিত হয়েছিল মিত্রশক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর একসময়ের সাম্রাজ্যবাদী জাপান যুক্তরাষ্ট্রের ব্লকে যোগ দিতে বাধ্য হয়। এখন অবধি তাই আছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধকালেও টোকিও-মস্কোর সম্পর্কে উত্তেজনা ছিল। এরপর কখনো একটু স্বাভাবিক, কখনো অবিশ্বাস-উত্তেজনা, এমনভাবে এগোচ্ছিল সম্পর্ক। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ জাপান ও রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে নিয়ে গেছে।
একদিক থেকে দেখলে জাপান ও রাশিয়া কিন্তু এখনো যুদ্ধের মধ্যে আছে। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। সমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। কিন্তু রাশিয়া ও জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। আট দশক ধরে দুই দেশের মধ্যে যেকোনো শান্তি আলোচনায় বিষফোড়া হয়ে হাজির হয়েছে চারটি দ্বীপের কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ। জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপের উত্তর প্রান্তের এই চারটি দ্বীপের ওপর রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।
আছে মহাপরাক্রমশালী চীন
জাপান ও রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে যেকোনো আলোচনা করতে গেলেই অবধারিতভাবে আসে মহাপরাক্রমশালী চীনের নাম। জাপান দেশটি রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া দিয়ে ঘেরা। জাপানের বুদ্ধিজীবী সমাজে আলোচনা আছে, ইউক্রেনে রুশ অভিযান নিকট ভবিষ্যতে বেইজিংকে প্ররোচিত করতে পারে। অর্থাৎ চীন তাইওয়ানে অভিযান চালিয়ে ছোট ভূখণ্ডটি দখল করে নিতে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জাপান সফরকালে প্রধানমন্ত্রী কিশিদাকে পাশে রেখে বলেছেন, চীন প্রতিবেশী তাইওয়ানে সামরিক হামলা চালালে চুপ করে বসে থাকবে না যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানকে রক্ষায় প্রয়োজনে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেবে তারা। জাপানের নেতারাও বিভিন্ন সময় এমন বক্তব্য দিয়েছেন। এর জবাবে চীন বরাবরই বলে আসছে, তাদের জনগণের দৃঢ়সংকল্প ও সক্ষমতাকে কেউ অবজ্ঞা করতে পারেন না। বোঝাই যাচ্ছে পরিস্থিতি উত্তপ্ত।
প্রসঙ্গত, জাপানের সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ, সাকিশিমা দ্বীপপুঞ্জ ও ইয়োনাগুনি দ্বীপ তাইওয়ান থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটারের মতো দূরে অবস্থিত। তাইওয়ানে চীনের একটি সশস্ত্র আক্রমণ জাপানের জন্যও একটি গুরুতর বিপদ হয়ে উঠতে পারে।
অবশ্য জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বড় ধরনের সামরিক ঘাঁটি আছে। এর একটি দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ ওকিনাওয়ায়, যেখান থেকে আকাশপথে তাইওয়ানের দূরত্ব অল্প। তাইওয়ানে চীনের কোনো আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ার ক্ষেত্রে এই ঘাঁটি গুরুত্বপূর্ণ।
শিনজো আবের প্রচেষ্টা
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাপানের এমন শক্ত অবস্থান মস্কোর একাকিত্ব আরও বাড়াবে, যা দেশটিকে পুরোপুরি চীনের বলয়ে ঠেলে দিতে পারে। এরই মধ্যে তাইওয়ান বিষয়ে রাশিয়া তার বক্তব্য স্পষ্ট করেছে। রাশিয়া বলেছে, তারা মনে করে তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাশিয়ার এমন অবস্থান জাপানের জন্য উদ্বেগজনকই হবে মনে করা হচ্ছে।
অথচ শিনজো আবে ২০১২ সালে দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসার পর রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নিলেও শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাননি শিনজো আবে। কারণ, তাঁর চেষ্টা ছিল বিরোধপূর্ণ চারটি দ্বীপ, জাপান যাকে নর্দান টেরিটোরিস হিসেবে বলে থাকে, তা নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো।
শিনজো আবে রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর জন্যও অনেক চেষ্টা করেছেন। ভ্লাদিভস্কে ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরামে যোগ দিতে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবারই রাশিয়ায় গেছেন তিনি। আট বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তিনি পুতিনের সঙ্গে অন্তত ২৭ বার বৈঠক করেছেন। আবে চেয়েছিলেন, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রেখে চীনের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে। কারণ, ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের প্রভাব বাড়ছে, আর জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা, অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক। ২০১৬ সাল থেকে জাপান এ বিষয়ে বেশি তৎপর। ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিতে ভারসাম্য আনতে শিনজো আবে ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে কোয়াড গঠন করেন, যদিও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। প্রসঙ্গত, শিনজো আবে ২০০৬ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জাপানের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কিশিদা কেন এমন?
প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কিশিদা কেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে এমন শক্ত ব্যবস্থা নিতে গেলেন? দুটি বড় শক্তির সঙ্গে তিনি কতটুকু এঁটে উঠতে পারবেন?
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ঐতিহাসিকভাবেই কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাপান কোনো দেশের প্রতি অবরোধ আরোপ করায় বিশ্বাসী ছিল না। জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোই কিশিদাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছে বলে বলা হচ্ছে।
পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিয়ে কিশিদা এমন বার্তা দিতে চেয়েছেন যে ভবিষ্যতে চীন যদি তাইওয়ানে কোনো ধরনের অভিযান পরিচালনা করে, তখন তিনি আশা করবেন, পশ্চিমারাও টোকিওর পাশে এসে দাঁড়াবে।
এমনিতে রাজনীতিবিদ হিসেবে কিশিদা অপরিপক্ব নন। তিনি রাজনৈতিক পরিবারেরই সন্তান। তাঁরা বাবা মন্ত্রী ছিলেন, আর দাদা ছিলেন এমপি। বাবার কর্মসূত্রে কিশিদার স্কুলজীবন কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। বলা হয়ে থাকে, তরুণ বয়সে একটা ‘পশ্চিমা মন’ গড়ে ওঠে কিশিদার।
প্রধানমন্ত্রী কিশিদা হিরোশিমার মানুষ, যে শহর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে পরমাণু বোমায় বিধ্বস্ত হয়েছিল। ওই বোমা হামলার ১২ বছর পরে তাঁর জন্ম। পরিবারের সদস্যদের কাছে পরমাণু বোমার ভয়াবহতার গল্প শুনে তিনি বেড়ে উঠেছেন।
ফুমিও কিশিদা প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মন্ত্রিসভায় দীর্ঘদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করেন। চীন, রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, কখন কী কৌশল গ্রহণ করতে হবে, কোনো কিছুই তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। তারপরও তিনি কম কৌশলের পথ গ্রহণ করে কেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে এতটা খড়্গহস্ত হলেন, সেটা একটা প্রশ্ন বটে।
কিশিদা এরই মধ্যে রাশিয়া থেকে কয়লা আমদানি নিষিদ্ধ করেছেন। যদিও তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি চলছে। এবং পুতিনের দাবিমতো জাপানকে রুবলে মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। একে কিশিদার একধরনের নৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এপ্রিলে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন ৭৩ দশমিক ৭ শতাংশ জাপানি। অর্থাৎ এখনো সাধারণ জাপানিরা প্রধানমন্ত্রী কিশিদাকে সমর্থন দিচ্ছেন। তবে এই সমর্থন কত দিন টেকে, সেটাই বিষয়। এ নিয়ে জাপানের কেইও ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক সুরুয়োকা মিচিতো এক নিবন্ধে লিখেছেন, কিশিদা সরকারের বোঝা উচিত জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে আর গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে জনগণের মত যেকোনো সময় বদলে যেতে পারে।
****(তথ্য সূত্র: ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, দ্য ডিপ্লোম্যাটসহ একাধিক সূত্র)
• কাজী আলিম-উজ-জামান, প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুন ২৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,