লেখক:হাসান ফেরদৌস নিউইয়র্ক থেকে
‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, কখন জানেন? যখন আমরা, অর্থাৎ পৃথিবীর মানুষ, জাতিসংঘকে পিকাসোর কোনো কিম্ভূতকিমাকার বিমূর্ত শিল্পকর্ম না ভেবে তাকে এমন একটা চিত্র ভাবব, যা আমরা নিজেরাই এঁকেছি।’
কথাটা জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব সুইডেনের দাগ হ্যামারশোল্ডের। অনেকের মতে, এই বিশ্ব সংস্থার তিনিই ছিলেন সেরা মহাসচিব। তেমন একটা ছবি তিনি হয়তো আঁকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা আঁকতে গিয়ে নিজেকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ১৯৬১ সালে রোডেশিয়ায়, আজকের জিম্বাবুয়েতে, এক বিমান দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। অনেকের ধারণা, দুর্ঘটনা নয়; তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। শান্তির সন্ধানে তিনি কঙ্গো আসছিলেন, কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে ক্ষতি হতো দেশটির খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনে ব্যস্ত একাধিক ইউরোপীয় দেশের। সম্ভবত তাদের যোগসাজশেই নিহত হন হ্যামারশোল্ড।
সেদিন যেমন, আজও তেমন জাতিসংঘ একটি চিত্রকলা হয়ে রয়েছে, যদিও সেটি আর তেমন বিমূর্ত নয়। সংস্থাটির সম্ভাবনা বিপুল, কিন্তু সাফল্য অর্জনে তার ক্ষমতা ও সুযোগ সামান্যই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে এই সংস্থার জন্ম। সংস্থাটির প্রতিশ্রুতি ছিল পরবর্তী প্রজন্মকে যুদ্ধের নৃশংসতা থেকে রক্ষা করবে। আজ সেই প্রতিশ্রুতি শুধু অপূর্ণ নয়, অর্থহীন মনে হয়।
জাতিসংঘের চলতি মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনের সাধারণ বিতর্কের উদ্বোধনী ভাষণে নিজেই সে কথা স্বীকার করলেন।
তিনি বলেছেন, ‘আজকের বিশ্ব বিপুল সংকটের সম্মুখীন। এই বিপদের কারণ অভাব, ক্ষুধা, অসাম্য ও অব্যাহত যুদ্ধ। আমাদের পৃথিবী জ্বলছে, সবচেয়ে দুর্বল যারা, তারাই এখন সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে। জাতিসংঘ সনদে যে আদর্শের কথা বলা হয়েছে, আজ তা ব্যর্থ হতে চলেছে।’
যে কথাটা মহাসচিব বলেননি তা হলো, কেন, কারা এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী। তিনি চলতি সংকটের কারণ হিসেবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের উল্লেখ করেছেন, যে যুদ্ধ শুরু করেছে এই সংস্থার নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা পালন করে যে তিনটি দেশ, রাশিয়া (বা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) তার অন্যতম। বাকি দুটি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর বদলে তারাও ব্যস্ত এই যুদ্ধের আগুনে ঘৃতাহুতি দিতে। বিশ্বশান্তিতে অতিরিক্ত দায়িত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যের সম্মান দেওয়া হয়েছে।
যে রক্ষক, সে–ই ভক্ষক
অবস্থা কতটা অদ্ভুত অথবা দাগ হ্যামারশোল্ডের ভাষায় কিম্ভূতকিমাকার, তা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সর্বশেষ যুদ্ধ ঘোষণা থেকেই ঠাহর করা যায়। ইউক্রেন একটি স্বাধীন দেশ, তারা জাতিসংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৫ সালে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়েই তাকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দেশটি নিজেকে পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র দেশ ঘোষণা করে। প্রেসিডেন্ট পুতিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করার বদলে সে দেশের নিজস্ব সীমানায় দুটি অঞ্চল, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক দখলে আনার পাঁয়তারা করছেন।
নিউইয়র্কে যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিতর্ক শুরু হয়েছে, ঠিক সে সময় মস্কো থেকে জানানো হলো, ইউক্রেনের অধিকৃত এই দুই অঞ্চল রাশিয়ার সঙ্গে অঙ্গীভূত করার জন্য সেখানে গণভোট নেওয়া হবে। বিদেশি সৈন্যের উপস্থিতিতে কীভাবে এই গণভোট সম্ভব, সে ব্যাখ্যায় না গিয়ে পুতিন জানালেন, তাঁর রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্যপূরণে কেউ বাধা দিলে তিনি প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবেন। ‘এটা কোনো ধাপ্পা নয়,’ তিনি শীতল গলায় জানালেন।
পরিহাসের এখানেই শেষ নয়। ইউক্রেন বিদেশি শত্রুর হামলার শিকার হওয়ায় দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান জাতিসংঘের সাধারণ বিতর্কে সশরীর উপস্থিত থাকতে পারছেন না। এ কারণে রেকর্ডকৃত ভিডিওর মাধ্যমে ভাষণ প্রদানের অনুরোধ করেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। সে অনুরোধে আপত্তি জানাল কে? নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য, সংস্থাটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরাষ্ট্র রাশিয়া।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ঠাট্টা করে বলেছেন, এই পরাশক্তি একটি ভিডিও ভাষণকে ভয় পায়। ১০১ সদস্যরাষ্ট্রের আপত্তির কারণে রাশিয়ার বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা অবশ্য বানচাল হয়।
কিন্তু এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট এই সংস্থাকে নিজের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহারের চেষ্টা আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে। এর আগে ইরাক যুদ্ধের সময় দেখেছি আরেক স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি মিথ্যাচারের মাধ্যমে কীভাবে সংস্থাটিকে ব্যবহারের চেষ্টা
চালায়। সে ইতিহাস আমাদের জানা, এখানে তার পুনরুল্লেখ অবান্তর।
শুধু ইউক্রেন কেন, বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চলছে ইয়েমেন, লিবিয়া, সোমালিয়া ও আফ্রিকার আরও আধা ডজন দেশে। কয়েক দশক ধরে মাথার ওপর বন্দুক রেখে ফিলিস্তিন দখল করে রেখেছে ইসরায়েল। এসব প্রশ্নে মাঝেমধ্যে নিরীহ কিছু প্রস্তাব গ্রহণ ছাড়া আর কিছুই করার সাধ্য নেই জাতিসংঘের।
ভাষণ-উৎসব
যুক্তরাজ্যের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড বলেছেন, জাতিসংঘের বার্ষিক সাধারণ অধিবেশন আসলে একটি গ্যাবফেস্ট বা ভাষণ-উৎসব। এই সংস্থা কীভাবে ক্রমে পিকাসোর সেই কিম্ভূতকিমাকার বিমূর্ত ছবি হয়ে উঠছে, তা বোঝার জন্য সাধারণ পরিষদের চলতি ৭৭তম অধিবেশনের সাধারণ বিতর্কের কথাটাই ধরুন।
সারা পৃথিবী থেকে প্রায় দেড় শ নেতা-নেত্রী এখন নিউইয়র্কে, সবাই লাইন দিয়ে বসে আছেন কখন তাঁদের জন্য নির্ধারিত মিনিট পনেরোর ভাষণ দেবেন। নামে বিশ্বসভা, অথচ এই সভায় নেতা-নেত্রীরা যে ভাষণ দেন, তার প্রধান শ্রোতা বিশ্ব সম্প্রদায় নয়, যার যার দেশের মানুষ। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় প্রত্যেকের ভাষণে ঘুরেফিরে একই বিষয়, তাদের ব্যক্তিগত সাফল্যের সবিস্তার ইতিহাস।
অধিবেশনের প্রথম বক্তা ব্রাজিলের কথা ধরুন। প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর জন্য যে সময় নির্ধারিত ছিল, তার পুরোটাই তিনি ব্যয় করলেন নিজ দেশের রাজনৈতিক গল্পকথা শোনাতে, বিশেষ করে নিজে কত–কী সব করেছেন, তার ফুলানো-ফাঁপানো বিবরণ দিতে। শুধু তা–ই নয়, নিজের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী লুলা ডা সিলভাকে একহাত নিতেও তিনি ভুললেন না।
লুলার নাম না নিয়ে তিনি উপস্থিত বিশ্বনেতাদের জানালেন, এই লোক ও তাঁর বামপন্থী রাজনৈতিক দল যে কয় বছর ক্ষমতায় ছিল, দেশটি ভয়াবহ সংকটে পড়ে। এ সময়ে জাতীয় ঋণ বেড়ে যায়, রাজনৈতিক বিভক্তি তুঙ্গে ওঠে, দুর্নীতি আকাশ ছোঁয়। লোকটিকে (অর্থাৎ লুলাকে) দুর্নীতির দায়ে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়।
কদিন পরেই ব্রাজিলে নির্বাচন, সে কথা মাথায় রেখে একটি নির্বাচনী ভাষণ দিয়ে গেলেন বলসোনারো। যাঁরা সাধারণ পরিষদে সে ভাষণ শুনলেন, তাঁরা কেউই আসন্ন নির্বাচনে ভোট দেবেন না।
তাতে কি, নিজ দেশের পত্রপত্রিকায় তো সে ভাষণ সবিস্তারে ছাপা হবে! অথচ বলসোনারোর জন্যই যে ব্রাজিল ক্রমে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে, তাঁর ভুল নীতির কারণে প্রায় সাত লাখ ব্রাজিলবাসী কোভিডে মৃত্যু বরণ করেছে অথবা আমাজন জঙ্গল প্রায় উজাড় হতে বসেছে, সেসব কথা বিশ্বনেতাদের মনে করিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না। নির্বাচনে পরাজিত হলে তিনি যে ফলাফল মানবেন না বলে আগাম ঘোষণা দিয়েছেন, সে কথাও কেউ স্মরণ করিয়ে দিল না।
সাধারণ পরিষদের এই বার্ষিক অধিবেশন কতটা ‘ফার্সিক্যাল’ (প্রহসন), তার ব্যাখ্যায় রাজনৈতিক ওয়েব পত্রিকা ‘পলিটিকো’ ঘোষণা করেছে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মৃত (ইউএন জিএ ইজ ডেড)।
গুরুত্বপূর্ণ যা কিছু তা এই অধিবেশনে নয়, তার ফাঁকে ফাঁকে যেসব দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়, সেখানেই হয়। তাহলে এত ঘটা করে, সারা বিশ্ব থেকে নেতা-নেত্রীরা বিশাল লটবহর নিয়ে প্রতিবছর কেন এখানে আসেন? পলিটিকো তারও জবাব দিয়েছে। নিউইয়র্কে ‘শপিং’ করা খুব চমৎকার অভিজ্ঞতা।
অসম্পূর্ণ স্বপ্ন
অথচ এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার সময় ভাবা হয়েছিল, সাধারণ পরিষদ, বিশেষত তার বার্ষিক সাধারণ বিতর্ক হবে সেই ফোরামে, যেখানে শুধু বিশ্বের চলতি সমস্যা আলোচিত হবে তা–ই নয়, তার সমাধানেরও পথনির্দেশ করা হবে। পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে বিশ্বনেতারা অভিন্ন কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রশ্নে প্রধান ভূমিকা নিরাপত্তা পরিষদের, কিন্তু ভেটো ব্যবস্থার কারণে তার চরিত্র প্রবল অগণতান্ত্রিক।
পাঁচটি বৃহৎ শক্তি নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তাকে নিজেদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সাধারণ পরিষদে কারও কোনো ভেটো শক্তি নেই, সবাই সমান, সবার একটি ভোট। কিন্তু সুযোগ থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গ সংস্থা তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনের বদলে তা অনুষ্ঠানসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। ডেভিড মিলিব্যান্ড ঠিকই বলেছেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন গ্যাবফেস্ট বা বক্তৃতাবাজির উৎসব ছাড়া আর কিছু নয়। বিশ্বনেতারা ১৫ মিনিটের ভাষণ দিয়ে চলে যান, দিন যেতে না যেতেই সবাই সে কথা ভুলে যায়।
এখন সময় এসেছে জাতিসংঘকে নতুন করে আবিষ্কারের। সাত দশক আগে যে সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, বিগত সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে তাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিশ্বের মানুষকে সম্মিলিতভাবে যে ছবিটি আঁকার আহ্বান জানিয়েছিলেন দাগ হ্যামারশোল্ড, তাকে আবার আমাদের কল্পনায় স্থান দিতে হবে।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:সেপ্টম্বর ২৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,