লেখক: জেফরি ডি স্যাক্স
জি-৭ নেতারা এ সপ্তাহেই আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনায় বসছেন। নতুন করে যাতে শরণার্থীর ঢল বয়ে না যায়, নতুন করে যাতে রক্তক্ষয় না হয়, নতুন করে যাতে আর আফগান জনগণের ওপর দুর্দশা নেমে না আসে, সে জন্য জি-৭–এর নেতারা উপায় খোঁজার চেষ্টা করছেন—এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ বৈঠকে সাতটি দেশ মূলত তাদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভেন্যু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আফগান ইস্যুতে কী কী নীতি গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা করবে। কিন্তু যেহেতু জি-৭–এর টেবিলে নিরাপত্তা পরিষদের অপর দুই সদস্য চীন ও রাশিয়া থাকছে না, সেহেতু আফগানিস্তান ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে অভিন্ন মতের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে না।
এটি মাথায় রেখে জি-৭–এর নেতাদের তালেবানের অধীন আফগান সরকারকে বিচ্ছিন্ন না করে বরং তাদের মেনে নিয়েই তাদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত হবে। এটি শুধু আফগানিস্তানে অবস্থানরত পশ্চিমা নাগরিক ও ঝুঁকির মুখে থাকা আফগানদের শান্তিপূর্ণভাবে বের করে আনার ক্ষেত্রে সুফল দেবে তা-ই নয়, এর ফলে ভবিষ্যতের রক্তক্ষয়, মানবিক বিপর্যয় ও পশ্চিমা দেশগুলোতে শরণার্থীদের ঢেউ এড়ানোও সম্ভব হবে। এ সহযোগিতা না করে যদি যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের জি-৭ মিত্ররা আফগানিস্তানকে উন্নয়ন সহযোগিতা দেওয়া বন্ধ করে কিংবা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে তালেবান সরকারকে বাগে আনতে চায়, তাহলে সে চেষ্টা দিন শেষে ব্যর্থ হবে, ঠিক যেমনটি অনেকের ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য করে সেখানে ন্যাটো জোটের ২০ বছরের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশগুলোকে সাজা দেওয়ার কায়দাকানুন সম্পর্কে যতটা জানে, একটি দেশকে স্থিতিশীল করতে কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়ে ততটা জানে না বা জানার চেষ্টা করে না। এতে যুক্তরাষ্ট্রই শেষমেশ যথেষ্ট অপমানের শিকার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজনীতিক এখনো আফগানিস্তানের তালেবানকে কঠোর সাজা দেওয়ার পক্ষে কথা বলছেন। এখনো অনেকে বলছেন, সেখানে আবার মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হোক। এই লোকেরা তাঁরাই, যাঁরা সোভিয়েত আমলে মুজাহিদিনদের (যাঁদের মধ্য থেকে তালেবান ও আল–কায়েদার জন্ম হয়েছে) যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়াকে সমর্থন করেছিল। এই লোকেরা তাঁরাই, যাঁরা ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর অভিযানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এই লোকেরা তাঁরাই, যাঁরা বিশ্বাস করতেন, ওবামার প্রথম দফার সরকারের সময় আফগানিস্তানে সেনা বাড়ানোর কৌশল আফগানিস্তানকে টেকসই সরকার গঠনে সহায়তা করবে।
এই লোকদের মতামতকে উপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যদি দেখা যায়, তালেবান সত্যিকার অর্থে তাদের শত্রুপক্ষের লোকজনকে ক্ষমা করে দিয়েছে এবং নারী ও মেয়েদের ওপর দমনাভিযান চালাচ্ছে না, তাহলে জি-৭ভুক্ত দেশগুলো, জাতিসংঘের সংস্থাগুলো, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক—প্রত্যেকের উচিত হবে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জারি রাখা, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানো। হ্যাঁ, এটা ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীরা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করবে। কিন্তু মাথায় রাখা দরকার, মার্কিন নাগরিকেরা সব ধরনের আন্তর্জাতিক সহায়তা করতে করতে এখন অসমর্থ হয়ে পড়েছে। দক্ষিণপন্থীরা বিভিন্ন দেশে অভিযান চালিয়ে সেখানে প্রভুত্ব বিস্তার করতে চায়, কিন্তু সেখানকার উন্নয়নে সহায়তা করতে চায় না।
অনুষ্ঠেয় বৈঠকে জি-৭–এর খতিয়ে দেখতে হবে, কেন ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা উন্নয়ন প্রকল্প দেশটিকে স্থিতিশীল করতে এবং দেশটির সেনাবাহিনীকে তালেবানের সামনে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে শুধু আফগান দুর্নীতিবাজেরাই ছিল তা নয়, সেখানে আমেরিকান ঠিকাদারেরাও বড় ধরনের দুর্নীতি করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
জি-৭ বৈঠকেই ঠিক করতে হবে, আফগানিস্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা দরকার হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারকে কীভাবে কাজে লাগানো যাবে, তার একটি রূপরেখাও এ সম্মেলন থেকে বের করা দরকার হবে। কোনো কোনো মার্কিন রাজনীতিক হয়তো তালেবানের বিরুদ্ধে সরব কিছু যুদ্ধবাজ গ্রুপকে সহায়তা দিয়ে আফগানিস্তানে একটি অস্থিতিশীল আবহ জিইয়ে রাখার লোভ সামলাতে পারবেন না। তবে সে ধরনের প্রলোভনে মার্কিন প্রশাসনের পা দেওয়া উচিত হবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাক্স যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির টেকসই উন্নয়ন, স্বাস্থ্যনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ের অধ্যাপক।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,