লেখক: ড. সাদেকা হালিম।
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে প্রথমেই সব শিক্ষককে শুভেচ্ছা জানাতে চাই। শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড আর শিক্ষকদের বলা যায় শিক্ষার মেরুদণ্ড। আমরা দেখেছি, শিক্ষকরাই জাতির সংকট উত্তরণে সর্বাগ্রে ভূমিকা পালন করে থাকেন। শিক্ষকদের এ ভূমিকা মানবসম্পদ উন্নয়নে, দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়তে আর প্রশিক্ষিত মানুষ তৈরিতে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চশিক্ষা সর্বস্তরের শিক্ষক এ প্রচেষ্টায় জড়িত।
এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস এসেছে করোনা অতিমারির মধ্যে। করোনার মধ্যে দীর্ঘ দেড় বছরে সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ থাকলেও শিক্ষকরা বসে ছিলেন না। তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন। সরাসরি ক্লাস বন্ধের সময় অনলাইন কিংবা দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন নিশ্চিত করতে অনেক শিক্ষক নিরলস পরিশ্রম করেছেন। করোনা অতিমারির মধ্যে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে আমরা চিকিৎসকদের ভূমিকার প্রশংসা করি। চিকিৎসকরা যেভাবে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেবা দিয়ে গেছেন; তেমনি শিক্ষকরাও শিক্ষাসেবায় পিছিয়ে ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে; তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সমস্যাসহ সার্বিক দিক নিয়ে আমরা একটি নীতিমালা তৈরি করছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের ডিভাইস কিনে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছি। এখানে আমাদের শিক্ষকদের বহুমুখী দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। আমরা জানি, উন্নত-অনুন্নত দেশ তথা বলা চলে গোটা বিশ্বই অতিমারির সময়ে অনলাইননির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
দেড় বছর পর গত ১২ সেপ্টেম্বর আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি খোলা হয়েছে; হল খোলার ব্যাপারেও আমরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ মাসেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা সরাসরি শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করতে পারব বলে আশাবাদী। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের টিকা নিশ্চিতের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে যদিও অধিকাংশ শিক্ষার্থী বলা চলে টিকার প্রথম ডোজ সম্পন্ন করেছে। এ ক্ষেত্রেও আমরা শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের করোনার টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সরাসরি শ্রেণি কার্যক্রম এখনও শুরু না হলেও আমরা শিক্ষার্থীদের জরুরি পরীক্ষাগুলো নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি, যাতে অনার্স শেষ পর্যায়ে কিংবা মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত না হয়।
বলা বাহুল্য, এ বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য :’টিচারস অ্যাট দ্য হার্ট অব এডুকেশন রিকভারি’ বা শিক্ষা পুনরুদ্ধারের কেন্দ্রে রয়েছেন শিক্ষকরা। আমরা জানি, আমাদের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে ফিরলেও তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের একটা শিখন ‘গ্যাপ’ তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা পুনরুদ্ধারে শিক্ষকদেরই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষাবিদরাও বলেছেন, লার্নিং গ্যাপ কমাতে বহুবিধ পদক্ষেপের বিকল্প নেই। শুরুতেই এখন দায়িত্ব শিক্ষকদের। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে সংশ্নিষ্ট বিষয়ে পাঠ দেওয়ার আগে যাচাই করে দেখবেন, শিক্ষার্থীর আগের জ্ঞান আছে কিনা। না থাকলে তাদের পূর্বজ্ঞান দিয়েই পরবর্তী পাঠ কার্যক্রমে যেতে হবে। এ জন্য শিক্ষকদের বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হবে। শিক্ষকরা আন্তরিক হলে শিক্ষার্থীর গ্যাপ দ্রুত সময়ে পূরণ করা সম্ভব।
এখন শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের ‘মেন্টাল সাপোর্ট’ বা মানসিক সমর্থন দেওয়া জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কথা যদি বলি, তারা করোনার আগে এক ধরনের অবস্থায় ছিল। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছিল, কেউ হয়তো মেসে। অনেক শিক্ষার্থীই সে সময় টিউশনি বা অন্য কোনো কাজে যুক্ত থেকে পড়াশোনা চালিয়েছিল। অতিমারির সময় স্বাভাবিকভাবেই অনেকে তাদের সেসব কাজ হারিয়েছে। এখন নতুন করে যখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠবে; শহরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম চালিয়ে নিতে তাদের আবার হয়তো আয়ের পথ খুঁজতে হবে।
এ সময় শিক্ষকদের উচিত হবে এই সংকটকাল চালিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে সমর্থন দেওয়া। যদিও অনেক শিক্ষক ইতোমধ্যে এ কাজটি করে আসছেন। বিশেষ করে দীর্ঘ সময় বাড়িতে বসে থেকে শিক্ষার্থীরা যেন মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে সে জন্য শিক্ষকরা সমর্থন জুগিয়েছেন। তবে একটা বিষয় এ সময় সেভাবে রোধ করা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে। যাদের হয়তো স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস বা ভালো কোনো চাকরিতে ঢুকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করবে। তাদের কারও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। যদিও তাদের অনেকেই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। তারা হয়তো শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু ভয়ংকর যেটা ঘটেছে, সেটা হলো বাল্যবিয়ে অনেক বেড়ে গেছে। যাদের প্রাথমিকের পর থেকে কিংবা মাধ্যমিকে বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের অনেকেই বিদ্যালয়ে ফেরেনি বলে সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে আমাদের আইন আছে। শিক্ষকরাও নিশ্চয় এসব বিয়ে বন্ধে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছেন। কিন্তু আর্থিক অবস্থার কারণে অনেক পরিবারই যত দ্রুত সম্ভব মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে চেয়েছে।
শিক্ষা পুনরুদ্ধারে শিক্ষকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- এটা কেউই অস্বীকার করবে না। কিন্তু আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বিশেষ করে করোনা মহামারির অভিঘাতে যখন অনেক পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের বাস্তবতার আলোকেই অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক অবস্থা চিন্তা করে শিক্ষকদের পদক্ষেপ নিতে হয়। এখানেও তাদের চ্যালেঞ্জ বহুবিধ। শুরুতেই বলেছি, শিক্ষকরাই জাতির সংকট উত্তরণে সর্বাগ্রে ভূমিকা পালন করে থাকেন। এভাবে অতিমারির এ সংকটও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। তবে যে শিক্ষকরা জাতির জন্য নিরলস সেবা দিয়ে যান, তাদের আর্থিক দিকটিও দেখা প্রয়োজন। করোনার কারণে অনেক শিক্ষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অথচ প্রণোদনা পাননি। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের মর্যাদা এবং অন্যান্য স্তরে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। আমরা কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না। তবে শিক্ষকদের সর্বস্তরে আপন মর্যাদায় মহিমান্বিত করা হোক- এটাই প্রত্যাশা।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নতুন শিক্ষাক্রমের অনুমোদন দিয়েছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে যোগ্যতা ও দক্ষতাকে প্রাধান্য দিয়ে এ শিক্ষাক্রম চালু হবে। এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তার আগে শিক্ষাক্রমটি যথাযথ পরিমার্জনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
সব শেষে বলব, মানুষ নির্মাণের কাজটি করেন যে শিক্ষকরা, তাদের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার বিষয়টিও বিশ্ব শিক্ষক দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্রঃ সমকাল।
তারিখঃ অক্টোবর ০৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,