ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে এমরান আহম্মদ ভূঁইয়াকে বরখাস্ত করার বিষয়টি গতকাল শুক্রবার সকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছ থেকে জানতে পারেন সাংবাদিকেরা। এর সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর জানা যায়, এমরান তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে ‘আশ্রয় চাইতে’ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে গেছেন। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা দূতাবাসের মূল ফটকের পাশের অভ্যর্থনাকক্ষে অবস্থানের পর সন্ধ্যার দিকে আবার বাসায় ফিরে যান তিনি।
সরকারের অবস্থানের বাইরে গিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয়ে গত সোমবার বক্তব্য দিয়েছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া রাষ্ট্রের একজন আইন কর্মকর্তার এমন বক্তব্য রাজনৈতিক ও আইন অঙ্গনে শোরগোল তৈরি করেছিল। তাঁর বক্তব্যের মূল কথা ছিল, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে বিচারিক হয়রানি করা হচ্ছে।
তখনই অনুমান করা হচ্ছিল, এমরান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের (ডিএজি) পদ হারাতে পারেন। এমন ইঙ্গিত গত মঙ্গলবার দিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
আইনমন্ত্রী গতকাল সকাল ১০টার দিকে তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় যান। সেখানে সাংবাদিকেরা তাঁকে প্রশ্ন করেন, এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না; জবাবে তিনি বলেন, ‘ওনাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ডিএজির পদ থেকে এমরানকে বরখাস্তের যে আদেশ জারি করেছে, তাতে অবশ্য ৭ সেপ্টেম্বরের (গত বৃহস্পতিবার) তারিখ উল্লেখ রয়েছে। আদেশে বলা হয়, ‘দ্য বাংলাদেশ ল অফিসার্স অর্ডার ১৯৭২-এর ৪ (১) অনুচ্ছেদ অনুসারে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার নিয়োগাদেশ জনস্বার্থে বাতিলক্রমে তাঁকে ডেপুটি জেনারেল পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হলো।’
এমরান স্ত্রী-সন্তানসহ মার্কিন দূতাবাসে অবস্থান করছেন—গতকাল বিকেলে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে গণমাধ্যমকর্মীরা দূতাবাসের মূল ফটকের সামনে যান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সন্ধ্যা ৭টা ৩৮ মিনিটে একটি গাড়ি ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢোকে। পরে জানা যায়, সেই গাড়িতে করে অন্য একটি ফটক দিয়ে এমরান পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দূতাবাস ছেড়ে গেছেন।
এর আগে গতকাল বিকেলে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারকে এক খুদে বার্তার মাধ্যমে মার্কিন দূতাবাসে অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন এমরান। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আমি মার্কিন দূতাবাসে আজকে (শুক্রবার) পুরো পরিবারসহ আশ্রয়ের জন্য বসে আছি। বাইরে পুলিশ। আজকে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে…। আমার ফেসবুক মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে গত ৪-৫ দিন ধরে অনবরত হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এই সরকার ভালোবাসার প্রতিদান দেয় জেল দিয়ে। আমার আমেরিকার কোনো ভিসা নেই। স্রেফ ৩টা ব্যাগে এক কাপড়ে আমার ৩ মেয়েসহ কোনোক্রমে বাসা থেকে বের হয়ে এখানে বসে আছি। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।’
এমরান স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দূতাবাসে আশ্রয়ের জন্য যাওয়ার পর তাঁর বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেছিল প্রথম আলো। দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার মুঠোফোনে এক বার্তায় তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের কাছে আপনাদের জানানোর মতো কোনো তথ্য নেই।’
ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে দেওয়া একটি বক্তব্যের কারণে কয়েক দিন ধরে আলোচনায় আছেন এমরান। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ড. ইউনূস বিষয়ে খোলাচিঠি (বিবৃতি) দিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় দেড় শতাধিক ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে শতাধিক নোবেল বিজয়ীও রয়েছেন।
শ্রম আইন লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলার প্রেক্ষাপটে উদ্বেগ জানিয়ে তাঁরা ওই বিবৃতি দেন। এ বিষয়ে ৪ সেপ্টেম্বর এমরান আহম্মদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, ড. ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁর সম্মানহানি করা হচ্ছে এবং এটি বিচারিক হয়রানি।’
শতাধিক নোবেলজয়ীর ওই খোলাচিঠির বিপরীতে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়ার কথা রয়েছে, এমন দাবি করে তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কর্মরত সবাইকে এতে স্বাক্ষর করার জন্য নোটিশ করা হয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করব না।’
এর পরদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি (এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া) অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ডিএজি (ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল)। তিনি যদি সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন, তাহলে তাঁকে হয় পদত্যাগ করে কথা বলা উচিত অথবা অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমতি নিয়ে কথা বলা উচিত। তিনি সেটি করেননি।’ একই দিনে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওনাকে (এমরান) সই করতে আমি কখনো বলিনি। আমি কোনো দিন কোনো আইন কর্মকর্তা বা কাউকে সই করতে বলি না। আমাদের অফিস থেকে আমার জানামতে, নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, কোনো বিবৃতি তৈরি করা হয়নি।’
গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। তখন তিনি মার্কিন দূতাবাস থেকে গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলেন। তিনি বলেন, সকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য শোনার পর তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তাই মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। তবে তাঁর কোনো ক্ষতি হবে না, সে বিষয়ে আশ্বস্ত হয়ে পুলিশের পাহারায় বাসায় ফিরে যাচ্ছেন।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ: সেপ্টম্বর ০৯, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,