লেখক:সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় নয়াদিল্লি।
কয়েক দিন আগে ফুঁসে উঠেছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রীর নাম করে বলেছিলেন, ‘একসময় উনি নিজেকে চা–ওয়ালা বলতেন। এরপর বললেন চৌকিদার। এখন সিঁদুর বেচতে এসেছেন। এভাবে সিঁদুর বেচা যায় না। এতে দেশের মা–বোনেদের অসম্মান করা হয়।’
প্রায় একই প্রতিধ্বনি শোনা গেল পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত সিং মানের কথায়। রাজ্যের মা–বোনদের উদ্দেশে তাঁর প্রশ্ন, ওদের দেওয়া সিঁদুর মোদির নাম করে আপনারা কি সিঁথিতে লাগাবেন? এটা কি এক দেশ এক ভোটের মতো এক দেশ এক স্বামী প্রকল্প?
দিন কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন। তাঁর ভাষণের অনেকটা জুড়ে ছিল সিঁদুর মাহাত্ম্য। তা শুনে ক্ষুব্ধ মমতা জানতে চেয়েছিলেন, অন্যদের হাতে সিঁদুর তুলে দেওয়ার আগে কেন তিনি নিজের স্ত্রীর সিঁথি সিঁদুরে রাঙাচ্ছেন না? চেনা ঢংয়ে আক্রমণাত্মক মমতা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছিলেন, মনে রাখবেন, আপনি দেশের সব নারীর স্বামী নন।
এই মুহূর্তে সিঁদুর বিতর্ক এতটাই তীব্র যে শাসক দল বিজেপিকে কিছুটা পিছু হটতে হয়েছে। সরে আসতে হয়েছে ঘটা করে রাজ্যে রাজ্যে ঘরে ঘরে গিয়ে বিবাহিত নারীদের হাতে সিঁদুরের কৌটা তুলে দেওয়ার কর্মসূচি থেকে।
দেশের সব সংবাদপত্র, সব টিভি নিউজ চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওই কর্মসূচির কথা লিখলেও বিজেপির আইটি সেলের কর্তা অমিত মালব্য দিন চারেক পর জানান, এমন কোনো কর্মসূচিই নাকি দল গ্রহণ করেনি। সবটাই নাকি গণমাধ্যমের কল্পনা। সিঁদুর রাজনীতি নিয়ে তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখতে পেয়ে তাঁদের এই বোধোদয় কি না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক জল্পনা।
এমনটা যে হতে পারে, সেই ভাবনা তখন সম্ভবত বিজেপির হর্তাকর্তাদের মাথায় আসেনি।
সিঁদুরের প্রেক্ষাপটের দিকে একটু তাকানো যাক। ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামের নিস্তরঙ্গ প্রশান্তি খান খান করে দিয়েছিল সশস্ত্র গোষ্ঠীর বন্দুক। বেছে বেছে মারা হয়েছিল ২৬ জন পুরুষকে, যাঁদের অধিকাংশ স্ত্রী–পরিবার নিয়ে ভূস্বর্গ বিহারে এসেছিলেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫ জনই হিন্দু, একজন স্থানীয় ঘোড়াচালক। তিনি মুসলিম। হিন্দু পর্যটককে বাঁচাতে গিয়ে তাঁকে মরতে হয়।
আচম্বিত ওই ঘটনায় গোটা দেশ যখন বিহ্বল ও ক্ষুব্ধ, তখনই ৬ মে গভীর রাতে পাকিস্তানে হামলা চালায় ভারত। পরদিন ভোরে প্রভাতি দৈনিকগুলো জানিয়ে দিল, সেই হামলার পোশাকি নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’। দেশবাসী এ কথাও জানল, অভিযানের নামকরণ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। লোগোর ডিজাইনও নাকি তাঁরই পছন্দ করে দেওয়া।
নরেন্দ্র মোদির আমলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ২০১৬ সালে, উরি সেনাছাউনিতে হামলার পর। নিহত হয়েছিলেন ১৯ সেনাসদস্য। তখন সেনা অভিযানের কোনো পোশাকি নাম ছিল না। থাকলেও দেশবাসী জানতে পারেনি।
পরের হামলা তিন বছর পর, ২০১৯ সালে। সেই বছর পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয়েছিলেন ৪০ জন জওয়ান। ঘটনার ১২ দিন পর ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল। তাতে একটা মিগ–২১ ধ্বংসও হয়েছিল। সেই অভিযান ‘বালাকোট সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নামে পরিচিত। বাহিনীর সাফল্য ঘিরে সরকারি দাবি বহু প্রশ্নের জন্মও দিয়েছিল। বিরোধীরা ভারতীয় বিমান সেনার সাফল্যের প্রমাণ দাবি করেছিলেন। সে জন্য তাঁদের প্রবল সমালোচিতও হতে হয়েছিল। শাসকের চোখে তা ছিল দেশদ্রোহের শামিল। সত্য–মিথ্যা উন্মোচিত না হলেও সেই প্রচার উতরে দিয়েছিল নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দলকে। দ্বিতীয়বারের মতো দিল্লির মসনদে বসেছিলেন তিনি।
এবার পেহেলগামে হামলার জবাব দিতে মোদি সরকার যে অনেক আটঘাট বেঁধে নেমেছে, তার প্রমাণ ‘অপারেশন সিন্দুর’। ৬ মের রাত পোহাতে না পোহাতেই গোটা দেশ জেনে গেল সেই নাম, দেখে ফেলল সেই লোগো। বোঝা গেল, বালাকোটের মতো প্রশ্ন যাতে না ওঠে, সে জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী সতর্ক ছিল। প্রতিটি হামলা ছিল ‘ডকুমেন্টেড’, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।
তবে সবচেয়ে বড় চমক ছিল অভিযানের নামকরণ ও তার লোগোয়। কালো জমির ওপর বড় বড় করে সাদা ইংরেজি অক্ষরে লেখা ‘অপারেশন সিঁদুর’। সিঁদুরের দুটি ‘ও’–র একটি ঢাকনা খোলা গোল সিঁদুরের কৌটা। কৌটা থেকে ছিটকে পড়েছে কিছুটা সিঁদুর কালো জমির ওপর। ঠিক যেন রক্তের ছিটে। স্পষ্টতই, অভিযানের নামকরণ ও তার লোগো পছন্দের লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক অভিঘাত সৃষ্টি, যাতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানো যায়, যা হয়ে উঠবে ভোট রাজনীতির হাতিয়ার।
দেশের সব গণমাধ্যম প্রচার করেছে, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামকরণ ও তার লোগো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরই পছন্দ করা। এই প্রচার সত্যি না মিথ্যা, কেউ জানে না। কারণ, সরকার নিজে থেকে সেই দাবি জানায়নি। আবার ওই বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রচারও খণ্ডন করেনি। প্রধানমন্ত্রী নিজে বিভিন্ন জনসভায় ‘সিঁদুর’–এর মাহাত্ম্য প্রচার করে চলেছেন। বলেছেন, তাঁর ধমনিতে রক্ত নয়, রয়েছে তরল লাল সিঁদুর। তা নিয়ে ঠাট্টা–তামাশার বিরাম নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজারটা কৌতুক ও মিমের ছড়াছড়ি।
সনাতন ধর্মে নারীরা স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের কাছ থেকে সিঁদুর উপহার নেন না। এটা জানা সত্ত্বেও বিজেপি নেতারা জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে রাজ্যে রাজ্যে ঘরে ঘরে মোদির নামে নারীদের সিঁদুর পাঠানোর সিদ্ধান্ত কেন নিলেন, সেটাই বিস্ময়ের। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে বিজেপি ব্রেক কষেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে, ওই খবরটা নাকি ছিল ‘ফেক নিউজ’।
সিঁদুর বিলি–বণ্টন নিয়ে কোনো কোনো রাজ্যে বিরোধী শাসক দলের সঙ্গে বিজেপির কাজিয়া চলছে। তর্ক–বিতর্কও অন্তহীন। বিহার বিধানসভার ভোট এই বছরের শেষে। সেখানে ইতিমধ্যে ‘সিঁদুর’ নিয়ে যা প্রচার চলছে, তাতে ঘরে ঘরে মোদির নামে সিঁদুর বিলি না হলেই বিজেপির মঙ্গল। দেশের সেনাপ্রধান অনিল চৌহান যুদ্ধবিমান হারানোর খবর মেনে নেওয়ায় প্রচারের তীব্রতা কিছুটা ফিকে হয়েছে। এ যেন এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ভাঙেন না, মচকানও না। বিহার জয়ে অপারেশন সিঁদুরই হবে তাঁর তুরুপের তাস।
সে জন্য তৎপরতাও তুঙ্গে। দিকে দিকে তৈরি হচ্ছে ‘অপারেশন সিঁদুর’ স্থাপত্য। একদিকে এক দল সেনাসদস্য, অন্যদিকে সহাস্য নরেন্দ্র মোদি। সেগুলো হয়ে উঠছে সেলফি পয়েন্ট। গুজরাট সীমান্তে গড়ে তোলা হচ্ছে ‘অপারেশন সিঁদুর স্মৃতি পার্ক’। কচ্ছ সীমান্তে ওই পার্কের একদিকে যেমন থাকবে পেহেলগামের দুঃসহ ঘটনার বিবরণ, অন্যদিকে তেমনই থাকবে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর ‘সাফল্য’।
সিঁদুর বিলি থেকে পিছিয়ে এলেও সিঁদুর মাহাত্ম্যের প্রচার থেকে বিজেপি মোটেই পিছপা হচ্ছে না। সরকারি প্রচারের গোটা ক্যানভাস আপাতত অপারেশন সিঁদুরেরই দখলে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুন ০৮, ২০২৫
রেটিং করুনঃ ,