যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি
মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার লাফঝাঁপ যেন বন্ধ হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে প্রতি মাসেই যেন মূল্যস্ফীতির হার আগের মাসকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, এ বছরের জুন মাসে গত বছরের জুন মাসের তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১। আর মে মাসের সাপেক্ষে জুন মাসে মূল্যস্ফীতি হার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত পেট্রোল ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে মূল্যস্ফীতির হার এতটা বেড়েছে। পেট্রোলের দাম গত মাসে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। গড়ে এখন এক গ্যালন পেট্রোলের দাম দাঁড়িয়েছে ৫ ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, জুন মাসে মূল্যস্ফীতির এই হার ১৯৮১ সালের নভেম্বর মাসের পর সর্বোচ্চ, মে মাসে যার হার ছিল ৮ দশমিক ৬।
দেশটির বিশ্লেষকেরা আশা করছেন, মানুষ পণ্যের তুলনায় সেবায় বেশি অর্থ ব্যয় করতে শুরু করলে মূল্যস্ফীতির এই গরম কিছুটা কমে আসবে। কিন্তু শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা বেশি থাকায় মজুরি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে আবার জিনসপত্রের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে।
কোভিডের কারণে সরবরাহব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে দুই বছর ধরে। এ ছাড়া মহামারি মোকাবিলায় মার্কিন সরকার যে পরিমাণ প্রণোদনা (সব মিলিয়ে ৫ লাখ কোটি ডলার) নাগরিকদের দিয়েছে, তাতে মানুষের হাতে বিপুল অর্থ জমে যায়। গত বছরের শেষ ভাগে কোভিড বিধিনিষেধ অনেকটা শিথিল হলে মানুষও হাত খুলে ব্যয় করতে শুরু করে। তার জেরে গত বছরের শেষ দিক থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে শুরু করে। এর এখন রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের ওপরে। আবার যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির বাজে প্রভাব পড়বে এশিয়ায়
লেখক:জিন পিং।
চরম মুদ্রাস্ফীতি বর্তমান বিশ্বের নতুন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি এশিয়ার দেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলা করতে যেখানে দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে কথা বলতে বা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ইউক্রেন সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, খাদ্য ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চলমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চরম মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অল্প সময়ে অত্যধিক পরিমাণগত সহজকরণ, চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাতের মতো অযৌক্তিক নীতি অনুসরণের পাশাপাশি ইউক্রেন সংকট বৃদ্ধি এবং দেশের অভ্যন্তরে মহামারি মোকাবিলায় বিশাল পরিমাণে আর্থিক ভর্তুকি প্রদানের মতো বিষয়গুলোর কারণে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। অর্ধশতাংশ পয়েন্টের রেকর্ড উত্থানসহ ফেডারেল রিজার্ভ এই বছর দুবার সুদের হার বাড়িয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০০ সালের পর এই প্রথম এত বেশি পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ ঘোষণা করেছে যে এটি জুন মাসে ব্যালেন্স শিট হ্রাস করা শুরু করবে। এসব পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই মুদ্রাস্ফীতির দেশের মানচিত্র ছাড়িয়ে অন্য দেশকে প্রভাবিত করার আশঙ্কা রয়েছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে এবং এর কুফল ভোগ করছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। ইতিমধ্যে এই অঞ্চলের অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার নতুন রেকর্ড গড়েছে।
এপ্রিল মাসে লাওসে এই হার ৯ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছায়, আর ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। মার্চ মাসে সিঙ্গাপুরের মুদ্রাস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৪ শতাংশে পৌঁছায়, যা ১০ বছরে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি এবং ১৪ বছরের সিপিআই রেকর্ডের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর থাইল্যান্ডে আগের বছরের তুলনায় মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
এপ্রিল মাসে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ বছর প্রতি সিপিআই বৃদ্ধির পরে ফিলিপাইন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের পর সবচেয়ে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির শিকার হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোর পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো মনে হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে অদূর ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতি নতুন রেকর্ড গড়বে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ফোকাস ইকোনমিকসের মতে, এই অঞ্চলের মুদ্রাস্ফীতির হার ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৩ শতাংশ, যা মার্চে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে সামগ্রিক জাতীয় ব্যয়ের অপেক্ষাকৃত বড় অংশ জুড়ে রয়েছে খাদ্যের জন্য বরাদ্দকৃত ব্যয়। এ বিষয়ে ব্যাংক অব আমেরিকা সিকিউরিটিজের আসিয়ান অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ফয়েজ নাগুথা উল্লেখ করেন, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির হার স্বাভাবিকভাবেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বৃদ্ধি এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির পরে এশিয়ার আর্থিক সংকট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। বৈদেশিক মুদ্রা ও শেয়ারবাজারে ডমিনোদের মতো একের পর এক পতন ঘটতে থাকে। ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দুই বছরের মধ্যে তাদের জিডিপি যথাক্রমে ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ হ্রাস পায়।
২০০৮ সালে মার্কিন মুলুকের সাবপ্রাইম মর্টগেজ সংকট সারা বিশ্বে আর্থিক সংকট তৈরি করে। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আর্থিক ব্যবস্থা আবারও নড়বড়ে করে দেয়। সিঙ্গাপুর স্ট্রেট সূচক ৪৫ শতাংশের বেশি কমে যায়। একটানা ভয়াবহ দরপতনের পর ইন্দোনেশিয়ার শেয়ারবাজারের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বাধাগ্রস্ত হয়। ফিলিপাইনের ৮০ লাখের বেশি বিদেশী কর্মী চাকরিচ্যুতি এবং আয় হ্রাসের ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। আর থাইল্যান্ডের প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক বেকারত্বের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করে।
এখন ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতা বিভিন্ন দিক থেকে আবারও উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। প্রথমত, এই হার বৃদ্ধির ফলে অর্থায়ন ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাবে এবং ক্যাপিটাল ফ্লাইটের সম্ভাবনা তৈরি হবে। উভয়ই উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলোকে প্রভাবিত করবে এবং এসব দেশের কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথ জটিল করে দেবে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন ডলারের উচ্চমূল্য ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর বোঝা আরও ভারী করবে, কারণ, অনুন্নত দেশের বৈদেশিক ঋণের অনুপাত সাধারণত বেশি থাকে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলার সূচকের ক্রমবৃদ্ধি অন্যান্য মুদ্রার ওপর অবমূল্যায়ন চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে অন্যান্য দেশে আরও বেশি মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে পারে।
যেহেতু চরম মুদ্রাস্ফীতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভয়াবহ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করতে নেতৃত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে এবং এর প্রভাব প্রশমিত করতে নিজেদের প্রস্তুত করার ব্যাপারে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে।
*****জিন পিং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের লেখক। গ্লোবাল টাইমস ও চায়না ডেইলির নিয়মিত লেখক।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুলাই ০৫, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,