সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পায়ে আমাদের সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধাঞ্জলি
তিনি তখন কলকাতার ভবানীপুর এল.এম.এস ইনষ্টিটিউশনে পড়াশোনা করছেন। এই স্কুলেই তিনি একেবারে বর্ণপরিচয় হতে শুরু করে এণ্ট্রান্স পাশ করেছেন। তখন তাঁর বয়স সাত বা আট। সেসময় তাঁর বাবা রোজ চারটে পয়সা দিতেন জলখাবারের জন্য। সেই পয়সায় তিনি অনেক বন্ধুদের খাওয়াতেন, নিজেও খেতেন। একদিন এক বন্ধুর শুকনো মুখ দেখে তিনি জানতে পারলেন যে, বন্ধুটির আগেরদিন রাত থেকেই কিছু খাওয়া হয়নি। সাথেসাথে তিনি নিজে কিছু না খেয়ে, বাবার দেওয়া সেই চার পয়সা দিয়ে অভুক্ত বন্ধুটিকেই ভাত খাইয়ে দিলেন, সাথে কিছু খাবারও দিয়ে দিলেন। এই ঘটনা জেনে তাঁর বাবা তাঁকে কোলে টেনে আদর করে গর্ব অনুভব করেছিলেন। এই ঘটনাটি ভবানীপুর এল.এম.এস ইনষ্টিটিউশনের শিক্ষক সুধীরকুমার চট্টোপাধ্যায় এক স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন। এতো ছোট বয়সেই এই ধরনের পরিচয় যিনি দিয়েছিলেন, তিনি বড় হলে যে মহাপ্রাণ হবেন তাতে আর আশ্চর্য কি। সেই ছোট্ট বালকটি পরবর্তীকালে হলেন আমাদের দেশবন্ধু.. সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক গুরু চিত্তরঞ্জন দাশ।
১৮৭০ সালের ৫ নভেম্বরে কলকাতায় চিত্তরঞ্জন দাশের জন্ম; বাবা ভুবনমোহন দাশ, মা নিস্তারিণী দেবীর প্রথম সন্তান। ১৮৯০ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। ঐ বছরই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বিলেতে গেলেন। ইংল্যান্ডে এসে দাদাভাই নৌরজীর পক্ষ সমর্থনে ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনের বিভিন্ন সভায় চিত্তরঞ্জন দাশ প্রচার ও বক্তৃতা করেন। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের মাটিতে দাঁড়িয়ে তাদেরই পার্লামেন্ট নির্বাচনে এক ভারতীয়’কে সমর্থন জানিয়ে প্রথম রাজনৈতিক হাতেখড়ি হয় চিত্তরঞ্জন দাশের। কিন্তু এই প্রচার বা বক্তৃতার করার জন্য, কৃতিত্ত্বের সাথে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করলেও তালিকা থেকে চিত্তরঞ্জন দাশের নাম বাদ যায়। এই অবস্থায় চিত্তরঞ্জন দাশ ব্যারিষ্টারী পড়তে শুরু করেন। ১৮৯২ সালে তিনি সসম্মানে ব্যারিষ্টারী পাশ করেন। ১৮৯৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতায় ফিরে আসেন এবং হাইকোর্টের বারে যোগ দেন। ১৮৯৭ সালে আসামের বিজনি ও অভয়াপুরী এস্টেটের দেওয়ান বরদানাথ হালদার ও হরিসুন্দরী দেবীর মেয়ে বাসন্তী দেবীর সাথে চিত্তরঞ্জন দাশের বিয়ে হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ ও বাসন্তী দেবীর তিন সন্তান- দুই মেয়ে অপর্ণা দেবী ও কল্যাণী দেবী ও এক ছেলে চিররঞ্জন দাশ।
দেশবন্ধু খুব কষ্টে মানুষ হয়েছেন বা তিনি খুব গরিব ঘরের সন্তান – একথা কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু নানা কারণে তাঁকে ঘোর অবস্থা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। দেশবন্ধুর দাদু কাশীশ্বর দাশ ও বাবা ভুবনমোহন দাশ কখনই কোনও বিপন্ন মানুষকে খালি হাতে ফেরাননি। কেউ ব্যবসার জন্য কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ধার করতে চাইল, আর তার জামিনদার থাকলেন ভুবনমোহন দাশ। কিছু মাস পরে সেই ব্যক্তি ব্যবসায় লালবাতি জ্বেলে বসে গেল, আর তার ধার শোধ করতে থাকলেন দেশবন্ধুর বাবা। এইরকম বিভিন্ন ঘটনা একবার নয়, বহুবার ঘটেছে। ফলে একসময় এই অত্যধিক দানের জন্য ভুবনমোহন দাশ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে বিশেষ আইনে আদালতে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ ঋণের টাকা আর শোধ করার দায় নেই। ১৮৯৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করেন। প্রায় ষোল বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে চিত্তরঞ্জন দাশ একটু একটু করে আয় করে টাকা জমিয়ে তাঁর বাবার ঋণ শোধ করেছিলেন। অথচ আইনত এই টাকা শোধ করার তাঁর কোনও দায় ছিল না। ব্যারিষ্টার হিসাবে তখনও চিত্তরঞ্জন দাশের বিরাট নামডাক হয়নি। ফলে তাঁর আয় তখন খুব বেশি হতো না। পয়সা বাঁচাতে এইসময় তিনি হাইকোর্ট থেকে বাড়ী ফেরার সময় পায়ে হেটে ফিরতেন, ট্রামের ছয় পয়সা ভাড়া বাঁচাতে। ১৯০৮ সালে মুরারীপুকুর মামলায় অরবিন্দ ঘোষের পক্ষ সমর্থনে চিত্তরঞ্জন দাশের সেই মামলা তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি লাভ করেন। ইংরেজ শাসনে এ এক অভাবনীয় ঘটনা। চিত্তরঞ্জন দাশের যশ-খ্যাতি সাড়া ভারতে ছড়িয়ে পড়ল। এই মামলা লড়া নিয়ে নিন্দুকেরা অনেক কথাই বলেছে, কিন্তু সত্যি হচ্ছে – এই মামলা থেকে চিত্তরঞ্জন দাশ এক পয়সাও নেননি। উপরন্তু এই মামলাতে পর্যাপ্ত অর্থ যোগানের জন্য তাঁর ঘোড়ার গাড়িটাও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। এই মামলার পর থেকেই চিত্তরঞ্জন দাশের আয় ক্রমশ বাড়তে থাকে, আয় পৌঁছায় মাসে পঞ্চাশ হাজারের বেশি। রোজগার মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা! তাও আজ থেকে ১১০ বছর আগে।
এইসময় চিত্তরঞ্জন দাশ আয় করেছেন যেমন, তেমন ভোগও করেছেন। আবার সেইসাথে করেছেন অকাতরে দান। তাঁর জীবন বিলাসিতার কথা লোকমুখে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পরল। রাজার মত ঐশ্বর্য তিনি রাজার মতই ভোগ করলেন। কিন্তু এই ভোগের মধ্যে ফুটে উঠলো এক অপরূপ বৈরাগ্য। নিঃস্বার্থ দান, নীরব দান যিনি করেন, তিনি সত্যিই মহাপুরুষ। মহানুভব চিত্তরঞ্জন দাশের দান এমনই ছিল, ডান হাত দিয়ে দান করলে বাম হাত টের পেত না। শুধু তাঁর বাড়ীতেই রোজ দুবেলা একশো একশো – দুশো লোকের খাওয়ার পাত পড়ত। প্রতিদিন সকাল ৮ থেকে ৯-টা চিত্তরঞ্জন দাশ শুধু ব্যাংকের চেক কাটতেন, অন্যের নামে। সেই চেক শুধু বাংলা নয়, সমস্ত ভারতের বিভিন্ন জায়গায়ে সাহায্য চাওয়া বিভিন্ন লোকের কাছে পৌঁছে যেত। ১৯২০ সাল, নাগপুর কংগ্রেস, সেখানে চিত্তরঞ্জন দাশ ঘোষণা করলেন- তিনি এখন থেকে ব্যারিস্টারী ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করবেন। সাড়া ভারত তথা বাংলা স্তম্ভিত .. আজ থেকে একশো বছর আগে আইন ব্যবসা হতে সেই সময় তাঁর আয় মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা ! সকল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের বাধাদানেও চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। বছরে আট লাখ টাকার সরকারি ওকালতির চাকরি তিনি এক কথায় ফিরিয়ে দিলেন ইংরেজ সরকার’কে। অভুতপূর্ব সমর্থন পেলেন স্ত্রী বাসন্তী দেবীর কাছ থেকে। নিজের সমস্ত শখ-আল্লাদ বিসর্জন দিলেন, নিজের ঘর-বাড়ী-গাড়ি দেশের কাজে দেশের লোকেদের দান করে দিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। নিজের বলতে এতটুকু কিছু রাখলেন না। দেশের মানুষ তাঁর নাম দিলে ‘দেশবন্ধু’।
১৯২১ সাল। সে সময়টি ভারতবর্ষ এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ – দুজনের ভাগ্যেই এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। চব্বিশ বছরের এক যুবক ব্রিটেনের মোটা মাইনের চাকরি ছুঁড়ে ফেলে ভারতবর্ষের মাটিতে পা রাখলেন। সেই যুবক প্রথম প্রশ্ন রাখলেন গান্ধীজীর কাছে, উত্তর পেলেন না। উত্তর পেলেন দেশবন্ধুর কাছে। সুভাষচন্দ্র বসুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন দেশবন্ধু। ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর দেশবন্ধুর সাথে সুভাষচন্দ্রও গ্রেপ্তার হন। ১৯২২, ১৪ ফেব্রুয়ারি বিচারে ছয় মাসের কারাদণ্ড হয়। সেই সময় জেলের বাইরে বহু স্বদেশী কর্মী পাহারা দিয়ে বসে থাকতেন। তাঁরা দেখেছেন, অনেক লোক বাইরে থেকে জেলের প্রাচীরে মাথা ঠুকে প্রণাম করছেন। জিজ্ঞেস করতে বলেছে- আমাদের জন্য দেশবন্ধু জেলে.. সেই মহাপ্রাণ’কে প্রণাম করছি। ১৯২২ সালে কংগ্রেসের সাথে দেশবন্ধুর মারাত্মক মতবিরোধ হয়েছিল। ১৯২৩ সালে কাউন্সিল নির্বাচনে স্বরাজ্য দল জিতবে, একথা তখন বাংলাতেই কেউ কল্পনা করেনি। মাথায় বিপুল ঋণভার নিয়েও দেশবন্ধু ত্রিশ হাজার টাকা ধার করেছিলেন নির্বাচনের খরচ চালাতে। ফলাফল কি হয়েছিল তা সকলেই জানি। কিন্তু সাফল্যের মূলে ছিল দেশবন্ধুর নেতৃত্ব, হার না মানা সংকল্প এবং অবশ্যই তাঁর জহুরীর চোখে ধরা পড়া সদ্য চাকরি ছাড়া বিলেত ফেরত তরুণ সুভাষচন্দ্রের অক্লান্ত উপস্থিতি। সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে তাঁর শুধুমাত্র রাজনৈতিক গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল না, ছিল পরস্পর বিশ্বাস, আস্থা, শ্রদ্ধা, আর অগাধ এক নি:স্বার্থ ভালোবাসা। তাই দেশবন্ধু দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, “আমি দেশকে এক শ্রেষ্ঠ রত্ন দিয়ে গেলাম।” সুভাষচন্দ্র বসু বলেছেন, “দেশবন্ধুর চরিত্র-কথা যতই আলোচনা হবে ততই মঙ্গল – কারণ তাঁর অন্তরে যে শক্তি, মহত্ব ও বিশালতা ছিল, তা মানুষ্য জীবনে সাধারণত দুর্লভ।”
উপাধি দুই প্রকার। এক, সরকার থেকে দেয়। আরেকরকম, দেশের জনগণ ভালোবেসে কাউকে দেয়। জনগণের দেওয়া এই রকম উপাধির নির্দিষ্ট কোনও রূপ নেই। জাতি ভালোবেসে কাকে কখন কি উপাধি দেবে, তা আগে থেকে ঠিক করা থাকে না। এইধরনের উপাধি জাতির অন্তর থেকে আপনিই উঠে আসে এবং সেই ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের সাথে উপাধি দেওয়া নাম একাকার হয়ে জড়িয়ে যায়। ‘দেশবন্ধু’ হলেন এই জাতীয় উপাধি। দেশবন্ধুর কাছে রাজনীতি ছিল সর্ব মনপ্রাণ দিয়ে এক ও একমাত্র দেশকে ভালোবাসা। দেশের জনগণকে ভালোবাসা ছিল তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। নিজের জন্য কিছু মাত্র না রেখে সর্বস্ব দান করে দিলেন। এই তীব্র অনুরাগ ও সর্বগ্রাসী ভালোবাসা তিনি দিয়েগিয়েছেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে .. অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ রূপে।
১৮৭০ – ২০২০ .. এই বছর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী.. তাঁর পায়ে আমাদের শ্রদ্ধা, প্রণাম ও ভালোবাসা জানাই।
সূত্র : সংগৃহিত
তারিখ: নভেম্বর ০৫, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,