লেখক: হাসান ফেরদৌস নিউইয়র্ক থেকে
গত ২০ বছরে আড়াই হাজার মার্কিন সৈন্য নিহত হলেও হতাহত সাধারণ আফগান নাগরিকের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। এই রণনীতি সাধারণ আফগানদের মার্কিনবিরোধী করে তোলে।
আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম সামরিক মিশন শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগে, ৩০ আগস্টের মধ্যরাতের পূর্বেই শেষ মার্কিন সৈন্য দেশে ফিরে গেছেন। ২০ বছরের সামরিক অধিগ্রহণ শেষে কার্যত পরাজয় স্বীকার করে বিশ্বের শেষ পরাশক্তিকে মুখ নিচু করে ফিরতে হলো। এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো আফগানিস্তানের যোদ্ধাদের হাতে পরাস্ত হতে হলো। এর আগে ব্রিটিশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নকেও হার মেনে ঘরে ফিরতে হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১০ বছর দখলদারির পর ১৯৮৯ আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায়। ব্রিটিশরা তিন দফায় মোট ৪০ বছর কাটানোর পর ১৯১৯ সালে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা মেনে নিয়ে প্রস্থান করে। আফগানিস্তানের নতুন শাসক হিসেবে এখন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তালেবান।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলের একাংশ, বিশেষত বিরোধী রিপাবলিকান নেতৃত্ব, এই পরাজয়ের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর প্রশাসনের ওপর সব দোষ আরোপ করছে। অপরিকল্পিত ও বিশৃঙ্খল এই সেনা প্রত্যাহার লজ্জাজনক। তাদের অভিযোগ, তালেবানকে বিশ্বাস করা যায় না, তাদের সঙ্গে কোনো রকম চুক্তি রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। এসব সমালোচক অবশ্য ভুলে যান, বাইডেন নয়, তালেবানের সঙ্গে সৈন্য প্রত্যাহারের চুক্তি করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত সে চুক্তি অনুসারে এ বছরের মে মাসে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি।
ভেতরে–বাইরে সমালোচনা
শুধু রিপাবলিকান নয়, ডেমোক্র্যাটদের একাংশও তড়িঘড়ি করে আফগানিস্তান ছেড়ে আসায় বাইডেনের সমালোচনা করেছেন। যেমন সিনেটর মার্ক কেলি বলেছেন, আগাম পরিকল্পনার অভাবেই এমন বিপর্যয়। কংগ্রেস সদস্য ক্রিসি হুলাহুন বলেছেন, এমন একটা কিছু ঘটতে পারে তেমন সতর্কবার্তা আমরা দিয়েছিলাম, কিন্তু হোয়াইট হাউস সে কথায় কান দেয়নি। এসব মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাটের যুক্তি, সীমিত আকারে মার্কিন সৈন্য সেখানে অবস্থান করলে আফগান সরকার এত দ্রুত এবং এত সহজে ভেঙে পড়ত না। সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমে এসেছিল। ফলে যত দিন ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আফগানিস্তানে থাকা অসম্ভব ছিল না। জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় এখনো মার্কিন সৈন্য রয়েছে, তাদের উপস্থিতির কারণেই এই দেশগুলো স্থিতিশীল সরকার গঠনে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে নিজেদের উদারনৈতিক মনে করেন এমন অনেক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যাঁদের দাবি, মানবিক কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানে থাকা দরকার ছিল। এখন সেখান থেকে সরে আসার ফলে মানবাধিকার, বিশেষত নারী ও বালিকাদের অধিকার পদপিষ্ট হবে। আফগানিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও অপূর্ণ রয়ে যাবে।
এই যুক্তি থেকে স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের ডান-বাম উভয় মহলই আফগানদের হাতে আমেরিকার এই পরাজয় মেনে নিতে পারছে না। আফগান জনগণের কল্যাণেই তারা সে দেশে গিয়েছিল, একথায় বিশ্বাসী মার্কিনদের পক্ষে এ কথা মেনে নেওয়া কঠিন যে নিজ দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলে পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ভিয়েতনামে সে চেষ্টা হয়েছে, লেবানন, ইরাক ও লিবিয়াতেও সে চেষ্টা হয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রে নাকে খত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরে আসতে হয়েছে। আফগান, বিশেষত পশতুন জাতিভুক্ত আফগান, কখনো বিদেশি প্রভুত্ব মেনে নেয়নি, সে প্রভু যত মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের দেশে আগমন করুক না কেন। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘আফগানিস্তানবিষয়ক ইন্সপেক্টর জেনারেল’ তাঁর ১১তম প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমরা আফগানিস্তানের চিরাচরিত রীতিনীতি বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই সেখানে “জাতি নির্মাণে”র কাজে হাত দিয়েছিলাম। এটা ভুল ছিল।’
আরও দুটি কারণের কথা বলেছেন পুলিৎজার বিজয়ী লেখক টিম ওয়াইনয়ার। প্রথম কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যে সন্ত্রাসবিরোধী রণনীতি অনুসরণ করে, তার ক্ষতিকর ফলাফল আফগান নাগরিকদের মার্কিন উপস্থিতির বিরোধী করে তোলে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা ও আইএস দমনের লক্ষ্যে যে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তার শিকার ছিল সাধারণ আফগান। বস্তুত গত ২০ বছরে আড়াই হাজার মার্কিন সৈন্য নিহত হলেও হতাহত সাধারণ আফগান নাগরিকের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। এই রণনীতি সাধারণ আফগানদের মার্কিনবিরোধী করে তোলে। মাত্র দুই দিন আগে আইএসের এক আত্মঘাতী বোমারুকে ঘায়েল করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে ড্রোন হামলা করে, তাতে ছয়টি শিশুসহ নয়জন আফগান নাগরিক নিহত হয়।
দ্বিতীয় কারণ, দেশ গঠনের নামে অধিকাংশ দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল মার্কিন সামরিক কন্ট্রাকটারদের হাতে। এরা কখনোই নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেনি, কখনোই বলেনি রাষ্ট্র বা জাতি নির্মাণের কোনো কাজে সাফল্য আসেনি। উল্টো অর্থ হাতানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে তারা অনবরত মিথ্যা গল্প শুনিয়ে গেছে। আফগান সামরিক বাহিনী যে কোটি কোটি ডলার ব্যয়ের পরেও নিজ সরকারের পক্ষে লড়াই করার বদলে অনেকে বিনা বাক্যে তালেবানের হাতে আত্মসমর্পণ করেছে। এর কারণ বিদেশি উপদেষ্টানির্ভর এই সরকারকে তারা কখনো বৈধ বলে মেনে নেয়নি।
যুদ্ধবিরোধী বাইডেন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডান-বাম উভয় মহলেই নিজেদের সৎ, নিরপেক্ষ ও পরহিতৈষী ভাবার একটি প্রবণতা রয়েছে। এই প্রবণতা থেকেই ইরাকে মার্কিন অভিযানের পক্ষে সায় দিয়েছিলেন অধিকাংশ মার্কিন। এঁদের অনেকেই উদারপন্থী শিবিরের মানুষ। যেমন ২০০২ সালে মার্কিন সিনেটে ইরাক হামলার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ২৯ জন ডেমোক্রেটিক সিনেটর, যাঁদের অন্যতম হলেন সিনেটের বর্তমান নেতা চাক শুমার। প্রতিনিধি পরিষদে সে যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এমন ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যা ৮১।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ইরাক যুদ্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। তবে পরবর্তীকালে তিনি সে ভোটকে ‘ভুল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ৯/১১–এর পর আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার প্রতি সমর্থন জানালেও পরবর্তী সময়ে তিনি যত দ্রুত সম্ভব আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে মত দেন। আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট ওবামা গ্রহণ করেন, বাইডেন তারও বিরোধিতা করেছিলেন।
সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কথা জেনেও যে বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সেটি সাহসী, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আরও ২০ বছর পরেও যদি এই সেনা প্রত্যাহার শুরু হতো, ফলাফল ভিন্ন হতো না। তাঁর এই সিদ্ধান্তের জন্য রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে, সে কথা বাইডেনের অজানা নয়। তা সত্ত্বেও তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছেন, তাঁকে সাহসী বলার সেটিই কারণ। তিনি খোলামেলাভাবেই স্বীকার করেছেন, ‘বিদেশিদের কবরস্থান’ হিসেবে খ্যাত আফগানিস্তানে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, কোনো বিদেশির পক্ষেই জোর করে দখলদারত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। এই অর্থহীন অভিযানে তিনি তাই আর একজন মার্কিন সৈন্যের জীবনও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নন।
উল্লেখ্য, অনন্তকাল আফগানিস্তানে পড়ে থাকা সম্ভব নয়, অন্য সবার আগে এই কথাটা বুঝেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখন জো বাইডেনের সমালোচনা করলেও বিদেশের মাটিতে ‘জাতি গঠনে’র বিরুদ্ধে তিনি জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। শুধু আফগানিস্তান নয়, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও জার্মানিতে অব্যাহত মার্কিন সৈন্য উপস্থিতিরও বিরোধিতা করেছিলেন ট্রাম্প। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ রক্ষণশীলদের আক্রমণ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। পরিহাসের ব্যাপার, ট্রাম্পের পরামর্শ মেনে ঠিক সেই কাজটি করায় এখন রক্ষণশীলদের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন জো বাইডেন।
এই মুহূর্তে সব সমালোচনা কাবুলে বিমানবন্দরে যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাকে ঘিরেই। টেলিভিশনের পর্দায় চাবুক হাতে টহলদানরত তালেবান ও ক্রন্দনরত আফগান শিশু ও নারীদের দেখে সবাই বাইডেনের ওপর চড়াও হয়েছে। অথচ সৈন্য প্রত্যাহার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিক বাইডেনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে এনবিসি কর্তৃক গৃহীত জনমত জরিপ অনুসারে, দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ মনে করে, আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সঠিক। তবে সিবিএসের ভিন্ন এক জরিপ অনুসারে, ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে, যেভাবে মার্কিন নাগরিকদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো, তা ঠিক হয়নি।
এই নেতিবাচক মনোভাবের প্রতিফলন পড়েছে বাইডেনের জনসমর্থনে। অবস্থার পরিবর্তন না হলে আগামী বছর মধ্যবর্তী নির্বাচনে বেকায়দায় পড়বেন বাইডেন। ডেমোক্রেটিক নেতৃবর্গ আশা করছেন, সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে চলতি সমালোচনার ঝড় থামলে মার্কিনরা তাঁদের মনোভাব বদলাবেন; বরং যে কাজ মুখে বলে বাস্তবায়ন করতে পারেননি ট্রাম্প, তা করে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য অভিনন্দিত হবেন বাইডেন। কোভিড নিয়ন্ত্রণে ও অর্থনীতিকে চাঙা করতে তাঁর প্রশাসনের সাফল্য নির্বাচনী বিপর্যয় এড়াতে সাহায্য করবে, এমন বিশ্বাসও তাঁদের রয়েছে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: সেপ্টম্বর ০১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,