তালেবান বাহিনী কাবুলের দখল নিতেই তিনি বুঝতে পারছিলেন, হঠাৎই তাঁর জীবন গভীর সংকটের মুখে পড়ে গেছে। তাঁর বিশ্বাস, তালেবানের জন্য তিনি হুমকি। তিনি বলেন, ‘আমার কণ্ঠস্বরের সেই শক্তি আছে, যা বন্দুকের নেই।’ তালেবান যখন দ্রুত গতিতে দখল করতে শুরু করে মৃত্যুর ঝুঁকি জানার পরও তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সেই আশাবাদ এখন নিরাশায় পরিণত হয়েছে।
প্রতিবাদী এই নারীর নাম জারিফা গাফারি। ২৯ বছর বয়সী এই নারী আফগানিস্তানের প্রথম নারী মেয়রদের একজন। তিনি নারী অধিকারকর্মী হিসেবেও বেশ পরিচিত। তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গাফারিকে বাড়ি ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ, তালেবান যোদ্ধারা তাঁর বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীকে মারধর করেন এবং তাঁর বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে তাঁদের। এ ঘটনার পর তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। এর কয়েক দিন পরই তিনি পরিবারের সঙ্গে জার্মানিতে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বিবিসিকে তাঁর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার কথা বলেন।
কয়েক বছর ধরেই জারিফার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ছিল। কারণ, ২০১৮ সালে মাইদান শারের মেয়র হওয়ার পর থেকে তাঁর ওপর বেশ কয়েকবার হামলা হয়েছে। ওই শহর বেশ রক্ষণশীল এবং সেখানে তালেবানের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। জারিফার ভাষ্য, তাঁর প্রতি ঘোর শত্রুতার শিকার হতে হয় তাঁর বাবাকে। গত বছর তাঁর বাবাকে হত্যা করা হয়। তিনি দেশটির সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য ছিলেন। জারিফার সন্দেহ, তালেবানই তাঁর বাবাকে হত্যা করেছে।
আগস্টের মাঝামাঝি সময় তালেবান যখন দ্রুতগতিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে শুরু করে, তখনই জারিফা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর দেশ ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে।
১৮ আগস্ট জারিফা গাফারি একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে পরিবারসহ কাবুল বিমানবন্দরে চলে আসেন। গাড়িতে বসার আসনের নিচের দিকে (যেখানে পা রাখা হয়) লুকিয়ে ছিলেন। পথে তালেবানের তল্লাশিচৌকিগুলো অতিক্রম করার সময় তিনি প্রতিবারই মাথা গুঁজে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘যখন বিমানবন্দরের গেটে পৌঁছাই , তখন চারদিকে তালেবান যোদ্ধারা। আমার নিজেকে লুকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়েছে।’
বিমানবন্দরে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত তাঁদের ইস্তাম্বুলের ফ্লাইট ধরতে সহায়তা করে। সেখানে থেকে তাঁরা জার্মানিতে চলে আসেন।
জারিফা বলেন, ‘আমি যখন বাবাকে হারাই, সেই অনুভূতি আবারও আমার জীবনে হবে, তা ভাবিনি। যখন আমি উড়োজাহাজে চড়ে বসি , সেই সময়ের অনুভূতি বাবাকে হারানোর চেয়ে আরও বেশি বেদনাদায়ক ছিল। কাবুলের যেদিন পতন হলো, সেদিনটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়। আমি এই কষ্ট থেকে কোনোভাবেই কাটাতে পারছিলাম না। কোনো দিন দেশ ছেড়ে যাব, ভাবিনি।’
জারিফা গাফারি তালেবান শাসনের অধীনে আফগান নাগরিকদের জীবন রক্ষায় রাজনীতিক ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠকের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে তালেবানের সঙ্গেও আলোচনা করতে প্রস্তুত। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমাদের একে অপরকে বুঝতে হবে। আমাদের সহায়তা করতে বিদেশি বাহিনী আসবে না। এখন আমাদের সময় তালেবানের সঙ্গে সমস্যার সমাধান করা। আমি এ দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।’ যদিও তিনি এখনো তালেবান বাহিনীকে বিশ্বাস করেন না। বিশেষ করে নারী অধিকার বিষয়ে।
২০০১ সালে তালেবান বিদায় নেওয়ার আগপর্যন্ত তারা ইসলামি আইনের দোহাই দিয়ে নারীদের স্কুলে ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। গত সপ্তাহে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘নারীরা অবশ্যই সমাজে সক্রিয় থাকবে, তবে তা ইসলামের নীতিমালার মধ্যে থেকে।’ তবে জারিফার এ নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, তাদের কথা ও কাজে কখনো মিল পাওয়া যায় না। তিনি আশা করেন, দেশে একদিন ফিরে আসতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমার দেশ। এটি গড়তে আমার অনেক বছরের অবদান আছে।’
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,