পরীমনিসহ কয়েকজন গ্রেপ্তার
অভিমত : নেপথ্যের ব্যক্তিদের হদিস তো পাচ্ছি না
মাদক, প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে সম্প্রতি চিত্রনায়িকা পরীমনিসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ নিয়ে নানামুখী আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সুলতানা কামাল অভিমত
লেখক সুলতানা কামাল, মানবাধিকারকর্মী
মানবাধিকারকর্মী হিসেবে এবং সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে, একটি গণতান্ত্রিক সমাজে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন হবে। দুটির জন্যই আমাদের আইনকানুন ও সাংবিধানিক নির্দেশনা রয়েছে, সুশাসনের নীতিমালা রয়েছে। আর সে জন্যই রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে।
আমাদের সংবিধানে বলা আছে, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক মর্যাদা ও সম্মান আছে। নাগরিকের সেই সম্মান ও মর্যাদা রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হবে। একটি কথা আমরা সব সময় বলি, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এটা শুধু যিনি অভিযুক্ত বা অপরাধী তাঁর ক্ষেত্রেই খাটে তা নয়, যিনি বা যাঁরা আইন প্রয়োগ করছেন, তাঁদের জন্যও প্রযোজ্য। সেই নিরিখে যদি বিচার করি, তাহলে এখন পরীমনিসহ একাধিক নারীর সঙ্গে যেসব আচরণ হচ্ছে, তাতে আমাদের বিব্রত বোধ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা এই আস্থা রাখলাম, যাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আছেন, তাঁরা সৎ উদ্দেশ্যে সমাজে এবং দেশে অপরাধ কমানোর এসব কাজ করছেন। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তাঁরা এসব কাজ করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এগুলো কী এমনই ঘটনা যে ওয়ারেন্ট (পরোয়ানা) ছাড়াই এভাবে গ্রেপ্তার করতে হবে?
মানবাধিকার ও আইনের শর্ত অনুযায়ী, আইন প্রয়োগের কিছু মাপকাঠি থাকে। শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে জনসমক্ষে এনে পরিচয় তুলে ধরায় একধরনের ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করা হচ্ছে। এভাবে জনতার আদালতে তাঁদের দাঁড় করানো কতটুকু সমীচীন? মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব আচরণে যথেষ্ট আপত্তির কারণ আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিচার বিভাগের মাধ্যমে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ তাদের ‘আসামি’ হিসেবেও অভিহিত করা যাবে না। কিন্তু তেমন ভাষাও ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিচারের পর যদি দেখা যায়, তাঁরা অপরাধটা করেননি, তখন অভিযুক্ত ব্যক্তির সুনাম ও মানসিক স্বাস্থ্যের যে ক্ষতিটা হলো, সেই ক্ষতিপূরণ করার কি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে? এ ধরনের আচরণ রাষ্ট্র তার নাগরিকের সঙ্গে করতে পারে না। মাদকাসক্তির মতো অনাচার, মানুষকে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মানুষকে বিপদে রাখা—এসবের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু আমাদের দাবিটা হলো, তারা এসব কিছু করবে আইনানুগ পদ্ধতিতে। তারা মানুষের অধিকার ও মর্যাদার শর্ত ভঙ্গ করবে না। আমাদের একটি বিষয় ভুললে চলবে না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিন্তু বিচারক নয়।
এখন যেসব মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, আমি আশা করছি তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন। তাঁরা অপরাধ করে থাকলে শাস্তি পাবেন। কথা হলো, এই অপরাধগুলো তো কেউ একা সংঘটিত করছেন না। যেসব বিবরণ আমরা পাচ্ছি সেখানে দেখা যাচ্ছে, আরও অনেক মানুষ জড়িত। এমনও মানুষ জড়িত আছেন, যাঁদের এ ধরনের ঘটনায় পৃষ্ঠপোষকতা করার আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষমতা আছে। যাঁদের সহযোগিতায় এসব অপরাধ হচ্ছে, নেপথ্যে থাকা তাঁদের একজনেরও তো হদিস আমরা পাচ্ছি না।
আমি নারী হিসেবে কাউকে রক্ষা করার জন্য বলছি না, কাউকে বাঁচানোর জন্য বলছি না। কিন্তু একটি কথা অনস্বীকার্য যে নারীরা অনেক সহজে এসব কাজে ব্যবহৃত হতে পারেন। সেসব ব্যবহারকারী ও পৃষ্ঠপোষকতা দানকারী কেন শাস্তির আওতায় আসছেন না। এসব পেছনের ব্যক্তিরা বলদর্পী, ক্ষমতাশালী। এঁরা অপরাজনীতি, কালোটাকার অর্থনীতি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁদের চিহ্নিত করা, বিচারের মুখোমুখি করা খুব দরকার। আশা করি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই দায়িত্ব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখবে।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ০৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,