পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের বৈশ্বিক চুক্তি পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে চার সপ্তাহের সম্মেলন শেষে যৌথ ঘোষণা প্রদানে অসম্মতি জানিয়েছে রাশিয়া। মস্কোর মতে, সম্মেলনে যৌথ ঘোষণার জন্য যে খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে, তা ‘রাজনৈতিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ’ নয়। তাই রাশিয়া এই ঘোষণা প্রদান থেকে বিরত রয়েছে। চলমান রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার এমন উদ্যোগ আগামী দিনগুলোয় বিশ্বশান্তির জন্য উদ্বেগ বাড়িয়েছে। খবর এএফপি ও বিবিসির।
বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৬৮ সালে সই করা হয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি)। এখন পর্যন্ত ১৯১টি দেশ এই চুক্তিতে সই করেছে। পাঁচ বছর পরপর দেশগুলো চুক্তিটি পর্যবেক্ষণে বৈঠকে বসে।
সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল ২০১৫ সালে। এরপর করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের বৈঠকটি পিছিয়ে যায়। প্রায় দুই বছর পর ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে এ বৈঠক শুরু হয়। স্থানীয় সময় গত শুক্রবার এনপিটিতে সই করা দেশগুলোর যৌথ ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল। এর কয়েক ঘণ্টা আগে রাশিয়া নিজেদের এমন অবস্থানের কথা জানায়।
নিজেদের আপত্তির কথা জানিয়ে জাতিসংঘে রাশিয়ার প্রতিনিধি ইগর ভিশনেভেৎস্কি বলেন, আলোচনা শেষে ৩০ পৃষ্ঠার বেশি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে এটি ভারসাম্যপূর্ণ নয়। রুশ প্রতিনিধিরা খসড়ার কিছু অংশের ভাষা নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। এটাও বলা হয়েছিল, খসড়ার ভাষা নিয়ে শুধু রাশিয়ার নয়, আরও কয়েকটি দেশের আপত্তি রয়েছে। তবে তা আমলে নেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে খসড়ায় সমালোচনা করা, একই সঙ্গে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এর আশপাশের এলাকায় সামরিক অভিযানের বিষয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ জানানো হয়েছে। খসড়ার এই অংশ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে মস্কো।
খসড়ার ঘোষণার বিষয়ে রাশিয়ার আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে এনপিটি–সংক্রান্ত আলোচনায় প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো জ্লাউভিনেন বলেন, এটা সমঝোতা অর্জনের সম্পূর্ণ বিরোধী একটি অবস্থান।
এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং বলেন, ‘রাশিয়া সমঝোতা প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। খসড়া ঘোষণা আটকে যাওয়ার এই ঘটনা আমাদের গভীরভাবে হতাশ করেছে।’ অন্যদিকে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি বনি জেনকিনস বলেন, এবারের সম্মেলনের ফলাফলের বিষয়ে রাশিয়ার অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনুতাপ করছে।
তবে এনপিটি–সংক্রান্ত আলোচনায় পরাশক্তিগুলোর অবস্থানের সমালোচনা করেছে অস্ট্রিয়া। দেশটি এক বিবৃতিতে বলেছে, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে এনপিটিতে সই করা ১৯১ দেশের তিন–চতুর্থাংশই খসড়ায় সম্মত রয়েছে। তবে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশগুলো (বিশেষত রাশিয়া) এটার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এনপিটি চুক্তির শর্তের বিপরীতে গিয়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে। এমনকি নিউইয়র্কে এবারের আলোচনার সময়ও এসব দেশের পক্ষ থেকে চুক্তির শর্ত পূরণে আন্তরিকতা দেখা যায়নি। বরং এসব দেশের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি।
আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়া ও খসড়া ঘোষণার ভাষা নিয়ে নিজেদের হতাশারা কথা জানিয়েছে চীন, নেদারল্যান্ডসসহ কয়েকটি দেশ।
যদিও এই সম্মেলনের শুরুতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, স্নায়ুযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক বিপর্যয়ের বিপদ এখনকার মতো আর কখনোই উপলব্ধি করা যায়নি। বর্তমানে বিশ্ব মানবতা ঝুঁকিতে রয়েছে। একটি ভুল–বোঝাবুঝি বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
উল্লেখ্য, জাপোরিঝিয়া ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। স্থাপনাটির আশপাশে ইউক্রেনীয় ও রুশ বাহিনীর পাল্টাপাল্টি হামলার কারণে এর নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমেই উদ্বেগ বাড়ছে। গত সপ্তাহে সেখানে আগুন লেগে ক্ষয়ক্ষতি হয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইউক্রেনের ন্যাশনাল গ্রিডের সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য জাপোরিঝিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি চেরনোবিলের মতো যেকোনো পারমাণবিক বিপর্যয়ের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। তবে রাশিয়া জানিয়েছে, আইএইএর প্রতিনিধিদল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিদর্শন করতে চাইলে মস্কো স্বাগত জানাবে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২৭, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,