করোনা মহামারির মধ্যে এসেছে আরও একটি ঈদ। আজ (জুলাই ২১) ঈদুল আজহা। সকালে ঈদের নামাজ আদায়ের পর পশু কোরবানি দিয়েছেন নগরবাসী। তবে ঈদ উদ্যাপনের সেই চিরচেনা রূপ ঢাকায় নেই। ঈদের দিন নগরে মানুষের ঘোরাঘুরি তেমন চোখে পড়ে না।
করোনার কারণে ঢাকার বিনোদনকেন্দ্র, যেমন পার্ক, চিড়িয়াখানা, শিশুমেলা ও সিনেমা হল সরকারের নির্দেশে বন্ধ আছে। তা ছাড়া কফিশপ, খাবারের দোকান খোলা থাকছে নানা বিধিনিষেধ মেনে। ফলে নগরবাসীর ঘোরাঘুরির জায়গা তেমন নেই। হাতিরঝিল, ধানমন্ডি লেক, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও ক্রিসেন্ট লেকে পরিবার–পরিজন নিয়ে সাধারণ মানুষকে ঈদ উদ্যাপন করতে দেখা গেছে। তবে সংখ্যাটা বেশ কম। করোনাকালের আগে রাজধানীতে ঈদ উদ্যাপনের মূল কেন্দ্রই ছিল এই এলাকা আর বিনোদনকেন্দ্রগুলো। ঈদের দিনগুলোতে থাকত উপচে পড়া ভিড়।
রামপুরার একটি চায়ের দোকানের সামনে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন তরুণ। সবাই একই এলাকার। তাঁদের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাফিউর রহমান বললেন, করোনার কারণে পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো সেভাবে হচ্ছে না। করোনার আগের ঈদে দুপুরে কোনো না কোনো আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত থাকত। অথবা আমাদের বাসায় স্বজনদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। কিন্তু এখন আর সেটা হচ্ছে না। রাফি জানালেন, সকালে ঈদের নামাজ পড়া এবং এরপর কোরবানির কাজে সহায়তা করেছেন তিনি। কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। তাই বাসা থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন।
রাজধানীর সড়কে যানবাহনের চাপ না থাকলেও উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের মোটরসাইকেল বেপরোয়া গতিতে চলতে দেখা গেছে। কিছু কিছু ব্যক্তিগত গাড়িও দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে সড়কে।
নিকেতনের বাসিন্দা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মো. শাহজাহান তরফদার বলছিলেন, ‘করোনাকালে চারটি ঈদের সঙ্গে আগের ঈদগুলোর বহু পার্থক্য রয়েছে। আমাদের মতো যাঁদের বয়স হয়েছে, পরিবারের সদস্যরা তাঁদের বের হতে দিতে চায় না। ভয় পায় করোনা হলে হয়তো আমাদের মতো বয়সীদের বাঁচানো যাবে না। এ কারণে ঈদে বাসা থেকে বের হচ্ছি না। নামাজ পড়ার পর বাসার গ্যারেজে কোরবানির সময় উপস্থিত ছিলাম। এবারের ঈদ উদ্যাপন এ পর্যন্ত।’
অবশ্য আলাপকালে বিভিন্ন সময়ের মানুষ করোনা নিয়ে যতটা ভয়ের কথা বলছেন, বাস্তবে নগরবাসী এতটা ভীত কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তরুণ-তরুণী যাঁরা ঘর থেকে বের হয়েছেন, তাঁদের অনেকের মুখেই মাস্ক ছিল না। মাস্ক না পরার অদ্ভুত যুক্তি দিলেন বাড্ডার সোনিয়া পারভিন। বললেন, ‘মাস্ক পরলে লিপস্টিক সারা মুখে লেগে যায়।’ উত্তরটা হয়তো সোনিয়ার নিজেরই পছন্দ হয়নি। তাই সঙ্গে সঙ্গে সোনিয়া বললেন, ‘আমরা বন্ধু-বান্ধবীরা যারা বেরিয়েছি, তাদের কারও করোনা নেই। এই কয়জনই তো আমরা একসঙ্গে ঘুরছি। অন্যদের সংস্পর্শে আসছি না। নিজেরা সতর্ক থাকছি।’
রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষেরা দিনভর বিভিন্ন বাসায় গিয়ে গিয়ে মাংস সংগ্রহ করছেন। দুপুরের দিকে কলাবাগানের কাছে মরিয়ম নামের একজন বলছিলেন, ‘সকালে দুটি বাসাবাড়িতে কাজ করেছি। দুই বাসা থেকেই মাংস পাব। তবে কাজ শেষে নিজে মাংস নিতে বিভিন্ন বাসায় গিয়েছি। ভালোই মাংস পেয়েছি।’ জানালেন, বাসায় ফিরে রান্না করবেন। তিন বাচ্চা, শাশুড়ি ও স্বামীকে নিয়ে খাবেন।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেল, প্রধান প্রধান সড়কে মানুষের চলাচল কম থাকলেও অলিগলিতে চায়ের দোকানের সামনে ছোট ছোট জটলা বেঁধে আড্ডা দিচ্ছে মানুষ।
ধানমন্ডি লেক ও হাতিরঝিলের দুজন নিরাপত্তাকর্মী বললেন, করোনার মধ্যে ঈদে মানুষের উপস্থিতি আগের তুলনায় কম থাকছে। তবে রোদ পড়লে লোকজন আসবে। রাত পর্যন্ত এসব এলাকায় ভিড় থাকবে। তাঁরা জানালেন, করোনার মধ্যে মানুষের যাওয়ার জায়গা তেমন নেই। এ কারণে খোলা উদ্যানে মানুষ জমা হয়।
করোনার প্রার্দুভাবে দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়ায় এবারও ঈদুল আজহার জামাত হয়নি। জনশূন্য ছিল ঈদগাহ মাঠটি। সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক এ বছর শোলাকিয়ায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি বলে জানান কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শামীম আলম।
জেলা প্রশাসক বলেন, শোলাকিয়ায় জামাত অনুষ্ঠিত না হলেও শহরের বিভিন্ন মসজিদে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এর আগে গত বছর ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে ঐতিহাসিক এই ঈদগাহে ১৯৩তম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৮২৮ সালে এই মাঠে ঈদের জামাতে সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছিলেন। সেই থেকে এই মাঠের নাম ‘সোয়া লাখিয়া’, যা এখন শোলাকিয়া নামেই পরিচিত বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
প্রতিবছর দূরদূরান্তের জেলাসহ দেশের বাইরে থেকে লক্ষাধিক মুসল্লি একসঙ্গে বড় জামাতে নামাজ আদায় করার জন্য একত্র হতেন। ঈদুল আজহায় তুলনামূলক এ মাঠে মুসল্লির সংখ্যা কম হলেও ঈদুল ফিতরে জনসমুদ্রের কারণে শোলাকিয়া মাঠ পূর্ণ হয়ে আশপাশের সড়ক ও বাড়ির ছাদে ছড়িয়ে পড়তেন।
তবে ২০১৬ সালে ঈদুল ফিতরের দিন মাঠের কাছে জঙ্গি হামলা ঘটনার পর ওই বছর ঈদুল আজহায় কঠোর নিরাপত্তায় মধ্যে স্বল্প পরিসরে ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে আবার মাঠের স্বাভাবিকতা ফিরে আসছিল এবং লক্ষাধিক মুসল্লির সমাগম ঘটেছিল। ঐতিহাসিক শোলাকিয়া মাঠে ঈদ জামাত শুরু হওয়ার পর থেকে করোনা মহামারির কারণে এবার নিয়ে পরপর দুই বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার চারটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুলাই ২১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,