লেখক: মোশতাক আহমেদ, ঢাকা।
রাজধানীর হাজারীবাগ সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ৭০ জন। সশরীরে ক্লাস শুরুর প্রথম দিন ১২ সেপ্টেম্বর এই শ্রেণিতে সেখানে উপস্থিত ছিল ৪০ জন, অর্থাৎ ৫৭ শতাংশ। গতকাল শনিবার ওই শ্রেণিতে উপস্থিত ছিল ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। তবে আগের চার দিন এই শ্রেণিতে উপস্থিতি ছিল ৬৪ থেকে ৭৯ শতাংশ পর্যন্ত।
রাজধানী থেকে ২৬৬ কিলোমিটার দূরের সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অচিন্ত্যপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সশরীরে ক্লাস শুরুর প্রথম দিন পঞ্চম শ্রেণিতে ৪৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিল ৩৬ জন। তবে এখন ৩২ থেকে ৩৫ জনের মতো উপস্থিত থাকছে। আর সুনামগঞ্জ পৌর শহরে অবস্থিত এইচ এম পি উচ্চবিদ্যালয়ে এসএসসিতে মোট পরীক্ষার্থী ৩৪৮ জন। তাদের মধ্যে অর্ধেকের মতো শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকছে।
এই তিন বিদ্যালয়ের মতো সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেই এখন শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘ দেড় বছর বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঝরে যেতে পারে। এর মধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যালয়পড়ুয়া কিছু ছাত্রীর বিয়ে হওয়ার তথ্য বের হচ্ছে। আবার কিছু শিক্ষার্থী শিশুশ্রমে জড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক অভিভাবক আবার করোনা সংক্রমণের কারণে শিশুকে স্কুলে পাঠাবেন কি না, তা নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছেন। অবশ্য শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঝরে পড়ার প্রকৃত চিত্রটি জানা যাবে আরও কিছুদিন পরে। আর একেবারে প্রকৃত হিসাব পাওয়া যাবে আগামী ডিসেম্বরে শিক্ষাবর্ষ শেষ হলে।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গতকাল বরিশাল এলাকার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে জানতে পারেন, আটজন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এই আটজনের মধ্যে আবার ছয়জন ক্লাসে ফিরেছে। বাকি দুজনকেও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থী মাছ ধরার কাজেও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু তারা আবার অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে। কেউ কেউ অন্য জায়গায় চলে গেলেও অ্যাসাইনমেন্ট পাঠাচ্ছে। ফলে, তারা ঝরে গেছে, তা বলা যাবে না। ঝরে পড়ার বিষয়টি বুঝতে আরও দু-এক মাস দেখতে হবে। তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন সব শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈনন্দিন তথ্য সংগ্রহ করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের তদারক ও মূল্যায়ন শাখা। গুগল ডকসের (অনলাইনে) মাধ্যমে তারা এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করছে। এই শাখার হিসাব অনুযায়ী ১৬ সেপ্টেম্বর গড় উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশ। এদিন সারা দেশের ১৮ হাজার ৩৯২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছে তারা। এতে প্রতিদিন ক্লাস হওয়া পঞ্চম (মাধ্যমিকের অনেক স্কুলে প্রাথমিক স্তরও আছে), দশম, এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৪৯ লাখ ৩৩ হাজার ৮৪১ জন। এর মধ্যে উপস্থিত ছিল ২৯ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭০ জন। পঞ্চম শ্রেণিতে ৭৪ শতাংশ উপস্থিত ছিল। দশম শ্রেণিতে ছিল ৬৩, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৩, একাদশ শ্রেণিতে ৪৮ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান। সংস্থাটির উপপরিচালক কে এম এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক যে কিছু কিছু শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। কেউ কেউ শিশুশ্রমে জড়িয়েছে। কিন্তু ঝরে পড়ার বিষয়টি বোঝার জন্য আরও দু-এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, করোনায় অনেক অভিভাবক এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় চলে গেছেন। অনেকে ফিরলেও আস্থার অভাব আছে। সে জন্য হয়তো এখনো সন্তানকে স্কুলে পাঠাননি। তাই এখন সবার আগে সব শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে আনার চেষ্টাটা করতে হবে।
বাংলাদেশে শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী দেশে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ১৭ দশমিক ৯০। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার ৩৫। উপবৃত্তিসহ নানা ধরনের উদ্যোগের কারণে ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আগে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি ছিল।
কিন্তু গত দেড় বছর বন্ধের কারণে এই ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও মাউশির উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তার মতে, বন্ধের মধ্যেও মাধ্যমিকে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এতে অংশ নিয়েছে। ফলে, ঝরে পড়ার বিষয়ে যে রকম আশঙ্কা করা হচ্ছে, তেমন হবে বলে তাঁরা মনে করছেন না। আবার স্বাভাবিক সময়েও অনেকে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে। কিছু শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে—এমনটা তাঁরাও আশঙ্কা করছেন। তবে সেটা বুঝতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সব শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, পরিচালনা কমিটি ও অভিভাবকদেরও চেষ্টা করতে হবে। সবাই মিলেই সব শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জ)
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ১৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,